বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের ব্যত্যয়

আপডেট : ১১ জুলাই ২০১৯, ২২:২০

আমাদের দেশে নব্বইয়ের দশকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। শিক্ষা খাতে সরকারের ওপর হইতে চাপ কমাইতে এবং বিদেশে শিক্ষার্থী ভর্তি প্রক্রিয়াকে নিরুত্সাহিত করিতে এই দেশে বেসরকারি খাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়। বর্তমানে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা শতাধিক। এইসব বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষার প্রসারে তাত্পর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করিতেছে। বিভিন্ন উন্নত বিশ্বে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিই সেখানকার উচ্চশিক্ষার প্রাণভোমরা। সেই হিসাবে আমাদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিও পিছাইয়া থাকিতে পারে না। ইতোমধ্যে আমাদের অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও গবেষণায় আন্তর্জাতিক সুনামও অর্জন করিতে শুরু করিয়াছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হইলেও সত্য যে, ইহার পরও আমাদের একশ্রেণির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়া যেমন প্রশ্ন রহিয়াছে, তেমনি সেখানে রহিয়াছে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি। তাহারা অনেক নিয়মকানুনের তোয়াক্কাও করিতেছে না। শুধু ইউজিসিরই নহে, খোদ উচ্চ আদালতের অনেক নির্দেশনাও তাহারা মানিতেছে না। তাহারা আমাদের শিক্ষার্থীদের জীবন নিয়া যে এক ধরনের ছিনিমিনি খেলে, তাহাও বলিবার অপেক্ষা রাখে না।

আইনে বলা হইয়াছে, কোনো বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের শর্ত না মানিলে সেখানে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ থাকিবে। কিন্তু সেই শর্ত না মানিলেও ঠিকই শিক্ষার্থী ভর্তি হইতেছে, খোলা হইতেছে নূতন নূতন বিভাগ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধে সরকার ২০১০ সালে নূতন আইন প্রণয়ন করে। কিন্তু সেই আইন কার্যকরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ভূমিকা নিয়া প্রশ্ন রহিয়াছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাইবার জন্য সময় বাঁধিয়া দিয়াছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু তাহা অমান্য করিয়া এখনো অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অস্থায়ী ক্যাম্পাসেই তাহাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালাইতেছে। অনেকে স্থায়ী ক্যাম্পাস গড়িয়া তুলিলেও সেখানে যাইতে গড়িমসি করিতেছে। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু বর্তমানে ২০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো উপাচার্য নাই। উপ-উপাচার্য নাই ৭২টিতে। কোষাধ্যক্ষ নাই ৫৩টিতে। এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকগণ নানা অনিয়ম জিয়াইয়া রাখিতে ও শিক্ষাবাণিজ্যের পথ অবারিত করিতেই এই পরিস্থিতি তৈরি করিয়াছেন। আইন অনুযায়ী কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষকের সংখ্যা পূর্ণকালীন শিক্ষকের এক-তৃতীয়াংশের বেশি হইবে না। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কথাই বলে। খণ্ডকালীন শিক্ষকের সংখ্যাই অনেক ক্ষেত্রে বেশি। দরিদ্রদের বিনা বেতনে পড়ানোর কথা থাকিলেও তাহা ঠিকমতন অনুসৃত হইতেছে না। শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি নির্ধারণ ও শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনকাঠামো ইউজিসিকে যথারীতি অবহিত করা হইতেছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক হিসাবনিকাশের অডিট রিপোর্ট প্রতিবত্সর ইউজিসিতে জমা দেওয়া হইতেছে না।

সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়া আমাদের বেসরকারি খাত বড়ো হইতেছে, শিক্ষাও ইহার বাহিরে নহে। ইহাকে আমরা ইতিবাচক হিসাবেই দেখি। কিন্তু নিয়ম-শৃঙ্খলা লঙ্ঘনের বিষয়টিকে মানিয়া নেওয়া যায় না। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক বর্তমান সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি। এইজন্য এইসব বিশ্ববিদ্যালয়কে আইনের আওতায় আনিতে হইলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও জরুরি। এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক সভা নিয়মিত অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। বর্তমানে ২০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়া তেমন কোনো অভিযোগ নাই। বাকিগুলির ব্যাপারে শর্ত পূরণের বিষয়গুলি তদন্ত করিয়া দেখিতে হইবে। এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাড়ে তিন লক্ষ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যতের স্বার্থেই বাড়াইতে হইবে নজরদারি।