বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

চিকিত্সা-বর্জ্যের স্বাস্থ্যঝুঁকি

আপডেট : ১৮ আগস্ট ২০১৯, ২০:৫৯

স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনো সুযোগ নাই বিভাগীয় শহর বরিশালে। এই শহরে প্রতিদিন চারটি সরকারি হাসপাতাল, ৪০টি ক্লিনিক, ১৮২টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার, একটি ব্লাডব্যাংক এবং ৯টি উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র হইতে অন্তত পাঁচ টন মেডিক্যাল বর্জ্য উত্পন্ন হয়। বরিশাল সিটি করপোরেশন সরকারি হাসপাতালগুলি হইতে এবং একটি এনজিও বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি হইতে এইসকল স্বাস্থ্যঝুুঁকিপূর্ণ বর্জ্য সংগ্রহ করে ঠিকই, কিন্তু ফেলিয়া রাখে নগরপ্রান্তের খোলা স্থানে। ছেলেমেয়েরা বর্জ্যের স্তূপে ঘোরাঘুরি করে। ফলে এইসকল বর্জ্য জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়ানক ঝুঁকিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। এইসকল বিষাক্ত বর্জ্য হইতে হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি, যক্ষ্মা ও ম্যালেরিয়ার মতো রোগ ছড়াইতে পারে। আর ব্যবহূত দূষিত সিরিঞ্জ হইতে এইচআইভি/এইডসও সংক্রামিত হইবার ঝুঁকি থাকে। তবে কেবল স্বাস্থ্যঝুঁকি নহে, উন্মুক্ত স্থানের বর্জ্যভাগাড় প্রাকৃতিক পরিবেশেরও ব্যাপক ক্ষতি করিতেছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মেডিক্যাল বর্জ্যের উন্মুক্ত ভাগাড় পানীয় জল এবং ভূ-উপরিভাগের জলাধারগুলিকেও দূষিত করিতে থাকে।

মফস্বলের কথা কী বলিব! দেশের সর্ববৃহত্ চিকিত্সাকেন্দ্র ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। সেইখানে প্রতিটি করিডরে রাখা কালো রঙের ডাস্টবিন। হলুদ বা অন্য রঙেরও রাখা আছে কোথাও কোথাও। বর্জ্যের ধরন অনুযায়ী তাহা নির্দিষ্ট রঙের ডাস্টবিনে ফেলিবার কথা। কিন্তু ব্যবহূত সুচ, সিরিঞ্জ কিংবা রক্তমাখা তুলা সবই ফেলা হইতেছে একই বিনে। আলাদা করিবার ব্যবস্থা নাই গজ, ব্যান্ডেজ, ঔষধের শিশি, ব্যবহূত স্যালাইন কিংবা রক্তের ব্যাগের। জীবাণুমুক্ত না করিয়াই কঠিন এই সকল চিকিত্সা-বর্জ্য চলিয়া যাইতেছে সাধারণ বর্জ্যভাগাড়ে। আর পরিশোধন ছাড়াই নালা-নর্দমা হইয়া তরল বর্জ্য মিশিতেছে নদীতে। অসত্ পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা এইসকল বর্জ্য হইতে বিক্রয়যোগ্য পণ্য বাছিয়া নিয়া অন্যত্র বিক্রয় করিতেছে বলিয়াও অভিযোগ আছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, রাজধানীতে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ৪ হাজার টন কঠিন বর্জ্য উত্পন্ন হয়। ইহার মধ্যে ৫০ টন আসিতেছে হাসপাতাল ও ক্লিনিক হইতে। আর এই বর্জ্যের মাত্র ৮ শতাংশ রহিয়াছে যথাযথ ব্যবস্থাপনার আওতায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, সারা দেশে সরকারি স্বাস্থ্যসেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান আছে ২ হাজার ২৩৫টির বেশি। তদুপরি চালু রহিয়াছে আরো প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক। এই ধরনের মোট ১৮ হাজার ক্লিনিক চালুর পরিকল্পনা রহিয়াছে। ইহার বাহিরের বেসরকারি খাতে নিবন্ধিত হাসপাতাল ও ক্লিনিক আছে ৩ হাজার ৫১৬টি। বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা প্যাথলজিক্যাল সেন্টার আছে ৬ হাজারের বেশি। শুধু রাজধানীতে ১ হাজার ২০০টি নিবন্ধিত ছোটো-বড়ো বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে। তাহার বাহিরে রাজধানীতে স্বাস্থ্যসেবা খাতে নিবন্ধনহীন আরো পাঁচ শতাধিক প্রতিষ্ঠান রহিয়াছে। এখনই এইসকল প্রতিষ্ঠানের বর্জ্যের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা না করিলে ভবিষ্যতে রোগপ্রতিরোধ কঠিন হইয়া পড়িবে।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকারী বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ওয়েস্ট কনসার্নের গবেষণা হইতে জানা যায়, ২০০৭ সালে সমগ্র দেশে চিকিত্সা-প্রতিষ্ঠানগুলিতে উত্পন্ন বর্জ্যের পরিমাণ ছিল ১২ হাজার টনের বেশি। ২০১৩ সালে তাহা বাড়িয়া দাঁড়ায় সাড়ে ১৯ হাজার টন। ২০১৭ সাল নাগাদ উত্পন্ন বর্জ্যের পরিমাণ সাড়ে ২১ হাজার টন। পরিবেশ আইনে রহিয়াছে, ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার স্থাপনের পূর্বে নিজস্ব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বা ব্যবহূত প্লাস্টিক সুচ, সিরিঞ্জ, টেস্ট, প্লাস্টিক বর্জ্য অটোক্লেভ যন্ত্রে জীবাণুমুক্ত করিয়া অপসারণ করিবার সুবিধা রাখিতে হইবে। প্যাথলজির তরল বর্জ্য পরিশোধনপূর্বক জীবাণুমুক্ত করিয়া অপসারণ এবং তুলা, গজ, ব্যান্ডেজ, ইত্যাদি পরিবেশসম্মতভাবে ইনসিনারেটরে পুড়াইয়া ফেলিবার ব্যবস্থা নিশ্চিত করিয়া পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র গ্রহণ করিতে হইবে। কিন্তু অধিকাংশ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়গনস্টিক সেন্টার পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়াই চলিতেছে। পরিবেশ আইন লঙ্ঘনকারী ক্লিনিক বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বিরুদ্ধে মামলা করিবার বিধান থাকিলেও কোনো ক্লিনিকের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর মামলা করিতেছে বলিয়া বিশেষ দেখা যায় না। বস্তুত সুনির্দিষ্ট আইন প্রয়োগে অনীহা, জনসচেতনতার অভাব, নিয়ন্ত্রণ ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে দেশের হাসপাতালগুলি বর্জ্য-ব্যবস্থাপনার আওতায় আসিতেছে না। প্রয়োজনীয় সচেতনতা না থাকায় অনেক প্রতিষ্ঠান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণও করিতেছে না। আমরা আশা করি, চিকিত্সা-বর্জ্যের স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনা করিয়া জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বাধ্য করিতে জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ গ্রহণ করা হইবে।