বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

আদি জামদানি কি ফিরিয়া আসিবে?

আপডেট : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ২১:৩৭

যাযাবর তার দৃষ্টিপাত গ্রন্থে লিখিয়াছিলেন, ‘বিজ্ঞান দিয়াছে বেগ, কাড়িয়া লইয়াছে আবেগ।’ কিন্তু সত্যিই কি বিজ্ঞান মানুষের আবেগ সবটুকু কাড়িয়া লইতে পারিয়াছে? মনে হয় না। মানুষের মানবিক গুণাবলি হইতে যদি আবেগ পুরোপুরি উঠিয়া যায়, তাহা হইলে মানুষ আর রোবটের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকিবে না। আবেগ আছে বলিয়াই এখনো আমরা লক্ষ্য করি পুরাতন দিনের একটি গান, একটি চলচ্চিত্র, একটি পোশাক, একটি ব্যবহারের জিনিস দেখিলে মানুষ স্মৃতিকাতর হইয়া পড়ে, ইংরেজিতে যাহাকে আমরা বলি নস্টালজিয়া। ইহা আবেগেরই অংশ। পুরাতনের প্রতি মানুষের রহিয়াছে স্বভাবগত দুর্বলতা। অতীতের পণ্য, অতীত দিনের পোশাক, চুলের স্টাইল তাই ঘুরিয়া ফিরিয়া আবার প্রচলিত হইতে দেখা যায়। এই কথা মাথায় রাখিয়াই বাংলাদেশ কারুশিল্প পরিষদ এবং বেঙ্গল ফাউন্ডেশন তাগিদ অনুভব করিয়াছে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী জামদানির আদি রূপ ফিরাইয়া আনিবার।  আজ ৬ সেপ্টেম্বর হইতে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত পাঁচ সপ্তাহব্যাপী যে জামদানি উত্সব অনুষ্ঠিত হইতে যাইতেছে তাহাতে নূতন করিয়া আদি সুতা ও মোটিফে পুরাতন ঐতিহ্য ফিরাইয়া আনিবার জন্য উপরিউক্ত দুইটিসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান উদ্যোগ লইয়াছে।

উদ্যোগটির প্রশংসা করিতেই হয়। ষোড়শ শতাব্দী হইতে উপমহাদেশ ও ইউরোপে অভিজাত নারী-পুরুষের কাছে জামদানি ছিল অতীব পছন্দের পোশাক। বিলাসিতার প্রতীক। বিভিন্ন উত্সব ও অনুষ্ঠানাদিতেও অভিজাতদের জন্য অপরিহার্য হইয়া ছিল জামদানি। এখনো মানুষ জামদানি পছন্দ করে। বাজারে এখনো লক্ষাধিক টাকা মূল্যের জামদানি পাওয়া যায়। এখনো অনুষ্ঠানাদিতে মানুষ জামদানি পরিধান করে। কিন্তু অতীতের সেই জামদানি আর বর্তমান জামদানির মধ্যে পার্থক্য বিস্তর। পূর্বে মসলিন কাপড়ের উপর নকশা করিয়াও জামদানি বানানো হইত। মসলিন বয়নে যেমন ৩০০ কাউন্টের সুতা ব্যবহার করা হয়, জামদানি বয়নে তেমনি ৭০-৮০ কাউন্টের সুতা ব্যবহার করা হইত। জামদানি বুননকালে তৃতীয় একটি সুতা দিয়ে নকশা করা হইয়া থাকে। বস্তুত পুরাতনকালের ঢাকাই মসলিনের পরবর্তী নকশাদার সংস্করণ হইল জামদানি এবং আমাদের এই ঢাকাই ছিল মসলিন ও পরবর্তী সময়ে জামদানির জন্য ইতিহাসে সুপ্রসিদ্ধ। জামদানি বলতে শুধু শাড়িকে বুঝানো হইলেও ইহা ওড়না, কুর্তা, পাগড়ি, রুমাল এমনকি শেরওয়ানি তৈরিতেও ব্যবহূত হইত।

কোনো কোনো ঐতিহ্য আছে যাহা অবহেলায় হারাইতে নাই। আমাদের জন্য জামদানি এমনই একটি ঐতিহ্য। উন্নত বিশ্বের লোকেরা সামনে আগাইয়া যায় ফেলিয়া আসা ঐতিহ্যকে মাথায় লইয়া। তাই উহাদের আগাইয়া যাওয়াও হয় দৃঢ়। অতীত হইল তিরের মতো। তির যত পিছনে টানিয়া লওয়া যায়, ধনুক তত সামনে গিয়া পড়ে, তত তীব্র বেগ পায়। সুতরাং আদি জামদানি ফিরাইয়া আনা গেলে কেবল ঐতিহ্যের সমাদরই হইবে না, সেই সঙ্গে বিপুলসংখ্যক কারিগরের এবং হাতে কাপড়ের কারুকাজ করিবার জন্য বহু মানুষের কর্মসংস্থানও হইবে। সেই সঙ্গে বহির্বিশ্বেও ইহার চাহিদা তৈরি হইতে পারে, যাহা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটি নূতন পথ করিয়া দিবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ এবং উদ্যোক্তাদের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন বলিয়াই আমাদের মত।