শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ফেসবুকের ফাঁদ পাতা ভুবনে

আপডেট : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ২১:০৪

রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয় একটি গান রহিয়াছে—‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে,/ কে কোথা ধরা পড়ে, কে জানে।’ গানটির প্রথম শব্দটি ‘প্রেম’-এর পরিবর্তে আমরা ‘ফেসবুক’ করিয়া দিতে পারি। ইহাতে ভুল বিশেষ হইবে না। ফেসবুকের ফাঁদে কে কোথায় ধরা পড়িতেছে—তাহা কেহই জানেন না। অনেক বেশি বিশ্বাস করিয়াই আমরা ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের মনের ভান্ডার খুলিয়া দিই। আর ফেসবুক সেই সকল তথ্য লইয়া ব্যবসা করে। ঘোষণা দিয়া এমন ব্যবসা ফেসবুক করিতেই পারে; কিন্তু মাধ্যমটি এমন একটি ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করিতে চাহে যে, ‘ব্যক্তিগত তথ্যের’ সুরক্ষিত ভান্ডার সে; কিন্তু আদতে যে ফেসবুক ‘শেয়াল’ এবং ব্যক্তিগত তথ্য নামের ‘মুরগি’কে তাহার নিকট বর্গা দিলে মুরগিটির পরিণতি যে ভালো হইবে না—তাহা বহুপূর্বেই দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। এই কারণে কিছুদিন পূর্বে সাবেক সিআইএ এজেন্ট এডওয়ার্ড স্লোডেন বলিয়াছেন, ব্যক্তিগত তথ্য কেনাবেচা করিয়া যাহারা রোজগার করে তাহাদের বলা হয় নজরদারি সংস্থা, আজকাল সেইগুলিকেই বলা হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। ফেসবুকের কর্ণধার মার্ক জাকারবার্গ বিভিন্ন সময় মাধ্যমটির তথ্যচুরির জন্য ক্ষমা চাহিয়াছেন; কিন্তু তাহার পরও সংস্থাটির প্রতি বিশ্বাস রাখিবার কোনো কারণ নাই বলিয়া মনে করেন বেশির ভাগ তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্লেষক। সম্প্রতি এই সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফরম হইতে ৪১ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষের ফোন নম্বর ফাঁস হইয়া গিয়াছে। এই অভিযোগ স্বীকারও করিয়া লইয়াছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ।

এই প্রায় ৪২ কোটি ফোন নম্বর চুরির ঘটনাটি অনেকের মতে, চোরের ওপর বাটপাড়ি করা হইয়াছে। ফেসবুকের অসুরক্ষায় হয়তো এই তথ্যচুরি হইয়াছে; কিন্তু ফেসবুকে নিজেও কি কম যায়? কত রকমের মনোমুগ্ধকর অ্যাপস ছড়াইয়া রহিয়াছে ফেসবুক জুড়িয়া। স্বাস্থ্য হইতে শুরু করিয়া সৌন্দর্য এবং বিভিন্ন কৌতূহলোদ্দীপক অ্যাপসগুলি একজন ব্যক্তি মনের আনন্দে ব্যবহার করিয়া থাকেন; কিন্তু ইহার আড়ালে তাহার বিভিন্ন ব্যক্তিগত তথ্য চলিয়া যায় ফেসবুকের নিকট, আর সেইসকল তথ্য ফেসবুক বিক্রয় করে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনী সংস্থার নিকট, কাস্টমাইডজ অডিয়েন্স ঠিক করিবার জন্য। অন্তত ১১টি জনপ্রিয় অ্যাপস রহিয়াছে, যাহাদের প্রত্যেকটিই কোটির বেশি গ্রাহক ডাউনলোড করিয়া ব্যবহার করিয়াছেন। এবং তাহার জন্য গ্রাহকের অনুমতি নেওয়া তো দূরের কথা, ইনস্টল হওয়ার সময়ও এইসব অ্যাপের তরফে কোনো নির্দেশিকা জানানো হয় না। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কাণ্ডের পর এমনতিই গ্রাহকতথ্য ফাঁসের জন্য একাধিক মামলায় ফাঁসিয়া রহিয়াছে ফেসবুক। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, লক্ষ লক্ষ ইউজারের ব্যক্তিগত তথ্য বিক্রয় করিয়াই রোজগার করে ফেসবুক। ইউজার যে তথ্য তাহার পোস্টে দেন, তাহা হইতে অনেক তথ্য ফেসবুক বাণিজ্যিক কারণে তৃতীয় পক্ষের হাতে তুলিয়া দেয়। সুতরাং অনেকেই বলিতেছেন, ফেসবুক আসলে তথ্যচুরির ঘটনায় ‘পরিস্থিতির শিকার’ নহে, তাহারা আসলে এই পরিস্থিতির ভাগীদার।

তবে সাধারণ মানুষকেও বুঝিতে হইবে, কেবল ফেসবুক নহে, ইন্টারনেটের জগতে প্রদান করা কোনো গোপন তথ্যই গোপন থাকে না শেষাবধি। সুতরাং কতটুকু তথ্য প্রকাশযোগ্য তাহা বুঝিয়া লইতে হইবে সাধারণ ব্যবহারকারীকেই।