বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

‘ত্যাগ চাই, মর্সিয়া-ক্রন্দন চাহি না’

আপডেট : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ২১:০৯

আজ ১০ই মহররম। পবিত্র আশুরা। ইসলামের ইতিহাসে বহুল আলোচিত, মর্যাদাপূর্ণ ও অবিস্মরণীয় এক দিন। ‘আশুরা’ অর্থ দশম, অর্থাত্ চান্দ্রবর্ষের প্রথম মাস মহররমের দশম তারিখকে বলা হয় আশুরা। এই পবিত্র দিনের সঙ্গে জড়াইয়া রহিয়াছে মুসলিম বিশ্বের নানা ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ। এমনিতেই আরবে জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও সফর—এই চারটি মাস অধিক মহিমান্বিত। আইয়্যামে জাহেলিয়াতের যুগেও এই মাসগুলিতে যুদ্ধ-বিগ্রহ ছিল নিষিদ্ধ। অধিকন্তু পবিত্র মাস মহররমের ১০ তারিখ আরো তাত্পর্যপূর্ণ। কেননা, এই দিনে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়া সৃষ্টি করিয়াছেন, আবার এই দিনেই সংঘটিত হইবে কিয়ামত বা মহাপ্রলয়। এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন প্রায় ২ হাজার পয়গম্বর। আদি পিতা হজরত আদমের (আ) দেহে পাক রুহ প্রদান, মা হাওয়াকে (আ) পয়দা, মহাপ্লাবন শেষে হজরত নুহ নবির (আ) ডাঙ্গায় অবতরণ, নমরুদের অগ্নিকুণ্ড হইতে হজরত ইব্রাহিমের (আ) নাজাত, মাছের পেট হইতে হজরত ইউনুসের (আ) নিষ্কৃতি, হজরত আইউবের (আ) রোগমুক্তি, হজরত মুসার (আ) নীল নদ পাড়িদান, হজরত ইসার (আ) ঊর্ধ্বগমনসহ অসংখ্য আলোড়ন সৃষ্টিকারী ও অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী এই দিবস। তবে বর্তমানে এই সবকিছুকে ছাপাইয়া ১০ই মহররম পরিণত হইয়াছে শোকাবহ একটি দিনের চিরন্তন প্রতীকে। কারণ ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দ মোতাবেক ৬১ হিজরির ১০ মহররমের এই দিনে কারবালার প্রান্তরে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে রসূলুল্লাহর (স) প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হুসাইন (রা)সহ ৭২ জন সঙ্গী-সাথি নির্মমভাবে শাহাদতবরণ করেন। বিশ্ব মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচাইতে মর্মান্তিক ও বিয়োগান্ত এই ঘটনা পবিত্র আশুরাকে দান করিয়াছে নূতন মাত্রা।

পবিত্র আশুরার মর্যাদার কারণে সুপ্রাচীনকাল হইতে গুরুত্বসহকারে পালিত হইয়া আসিতেছে আশুরার রোজা। এমনকি মাহে রমজানের রোজার পূর্বে আশুরার রোজাই ছিল  অবশ্যপালনীয়। পরে ইহা মুসলমানদের জন্য নফল বা ঐচ্ছিক রোজায় পরিণত হয়। তবে রমজানের পরই এই রোজার গুরুত্ব সর্বাধিক। রসুলুল্লাহ (স) এই দিনের আগে বা পরে মিলাইয়া দুইটি রোজা রাখিয়াছেন। এই দিন তওবা কবুল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বিধায় দিবসটি নফল রোজা, নামাজ, দান-খয়রাতসহ নানা ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে কাটানোই উত্তম। এই দিবসের মূল শিক্ষা হইল—আল্লাহর নিয়ামত লাভ করিয়া তাহার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়ানো। আমরা জানি, হজরত মুয়াবিয়ার (রা) ইন্তেকালের পর ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে তাহার পুত্র ইয়াজিদ মসনদে আরোহণ করে। কিন্তু সে ছিল  খেলাফতের বদলে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর, চুক্তি ভঙ্গকারী ও স্বৈরাচারী। ফলে মক্কা, মদিনা, কুফাসহ বহু অঞ্চলের মানুষ ইয়াজিদকে শাসক হিসাবে মানিয়া নিতে অস্বীকৃতি জানাইলে এক ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে কারবালা প্রান্তরে ঘটে এই পৈশাচিক ঘটনা।

হজরত ইমাম হোসাইন অসত্য ও অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী নাম। তাহার ও তাহার পরিবারবর্গের আত্মত্যাগ অত্যাচারিত-নিষ্পেষিত মানবতাকে অপশাসনের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইতে রোজ কিয়ামত পর্যন্ত অনুপ্রেরণা জোগাইবে। কবি বলেন, ‘কারবালার মতো আত্মত্যাগের পরই ইসলাম পুনর্জীবন লাভ করে।’ ইতিহাসের এই কলঙ্কিত অধ্যায় স্মরণে মাতম না করিয়া সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকা এবং যে কোনো আত্মত্যাগকে হাসিমুখে বরণ করিয়া নেওয়াই কাম্য। জাতীয় কবির ভাষায় বলিতে হয়— ‘ত্যাগ চাই, মর্সিয়া-ক্রন্দন চাহি না’। অতএব, পবিত্র আশুরায় প্রার্থনা করি—সত্যের উজ্জ্বল আলোয় দূর হউক মিথ্যার কালিমা। জয় হউক ন্যায় ও সত্যের। অন্যায়-অবিচার হইতে পৃথিবীকে মুক্ত রাখিতে ত্যাগের মহিমা ছড়াইয়া পড়ুক সবখানে।