বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বিশ্ব র্যাংকিং ও আমাদের উচ্চশিক্ষা

আপডেট : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ২১:৩০

বিশ্বব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের র্যাংকিং নির্ধারণ ও তাহা প্রকাশ করিয়া থাকে লন্ডনভিত্তিক শিক্ষাবিষয়ক সাময়িকী ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন।’ চলতি বত্সর তাহারা বিশ্বের ৯২টি দেশের ১ হাজার ৩০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি তালিকা প্রকাশ করিয়াছে; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেরা ১ হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ইহাতে স্থান পায় নাই। অবশ্য হাজারের পরে স্থান পাইয়াছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আরো হতাশাজনক খবর হইল, ২০১৬ সাল হইতে বর্তমান সময় পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পিছাইয়াছে ৪০০ ধাপ। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কেন এই অধোগতি? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এই র্যাংকিংকে প্রত্যাখ্যান করিয়া বলিয়াছেন যে, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই প্রকাশ করা হইয়াছে এই র্যাংকিং। তবে অনেক শিক্ষাবিদের মন্তব্য হইল, গবেষণার সংখ্যা হ্রাস, মানসম্পন্ন গবেষণায় বিনিয়োগের ঘাটতি, শিক্ষক নিয়োগে অস্বচ্ছতা, যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম না থাকা, অপরিণামদর্শী শিক্ষক-ছাত্র রাজনীতি, শিক্ষাবাণিজ্য, গবেষণার চাইতে সান্ধ্যকালীন কোর্সে শিক্ষকদের অধিক আগ্রহ প্রভৃতি কারণে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির শিক্ষার মান ও পরিবেশ ক্রমাগতভাবে নিম্নমুখী।

টাইমস হায়ার এডুকেশন শিক্ষার পরিবেশ, গবেষণার সংখ্যা ও সুনাম, সাইটেশন বা গবেষণার উদ্ধৃতি, এই খাত হইতে আয় এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বা সংশ্লিষ্টতাসহ পাঁচটি মানদণ্ড বিশ্লেষণ করিয়া এই তালিকা তৈরি করিয়াছে। তাহাদের এই তালিকার শীর্ষে রহিয়াছে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ডের নাম। প্রথম ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সাতটি ও কেমব্রিজ (৩য় স্থান)সহ যুক্তরাজ্যের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় রহিয়াছে। এশিয়ায় সবচাইতে ভালো অবস্থানে রহিয়াছে চীন ও জাপানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলি আমাদের তুলনায় অনেক ভালো করিয়াছে। এই তালিকায় ৩০০ হইতে শুরু করিয়া ১ হাজারের মধ্যে রহিয়াছে ভারতের ৩৬টি ও পাকিস্তানের সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা শিক্ষা ও সাক্ষরতার হার বৃদ্ধিতে আত্মতুষ্টিতে ভুগিতেছি; কিন্তু মানসম্পন্ন শিক্ষা অর্জিত না হইলে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন টেকসই হইতে পারে না। যেইখানে আমরা অর্থনৈতিক উন্নয়নের মহাসড়কে রহিয়াছি, সেইখানে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে আমরা কেন পিছাইয়া থাকিব? দেশে সরকারি বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়িতেছে; কিন্তু মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য দক্ষ শিক্ষক এবং অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা সেইভাবে বাড়িতেছে না। নূতন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে অভিযোগের অন্ত নাই।

আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের ঐতিহ্য লইয়া গর্ব করি; কিন্তু স্বাধীনতার পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষা ও গবেষণার যে নিরিবিলি ও উন্নত পরিবেশ দরকার তাহা কি আমরা নিশ্চিত করিতে পারিয়াছি? স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হইলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে কি সরকারি খবরদারি ও স্বেচ্ছাচারিতা বাড়ে নাই? চলতি বত্সরের মে মাসে একই সাময়িকী এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলির নামের যে তালিকা প্রকাশ করে, তাহাতেও ছিল না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। ইহার চাইতে লজ্জাজনক আর কী হইতে পারে? আমরা মনে করি, প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কিছু সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘুরিয়া দাঁড়াইবার সক্ষমতা আছে। এই কারণে দরকার গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ ও শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভিসি ড. ফিলিপ জোসেফ হার্টগের মতে, ‘সত্যিকারের বিশ্ববিদ্যালয় হইতে হইলে এখানকার শিক্ষকদের নিজেদের জ্ঞান বৃদ্ধিতে সমর্থ হইতে হইবে’। অতএব, উচ্চতর পর্যায়ে কল্পনা ও জটিল চিন্তাশক্তির সমন্বয়ে নূতন নূতন জ্ঞান উদ্ভাবনের প্রতি আমাদের গুরুত্বারোপ করিতে হইবে।