শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বজ্রপাতে উদ্বেগজনক প্রাণহানি

আপডেট : ০৭ অক্টোবর ২০১৯, ২১:২৬

জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে যে কেবল সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাইতেছে অথবা তাপমাত্রার পরিবর্তন হইতেছে তাহাই নহে, ইহার প্রভাব ঝড়-বৃষ্টি-বজ্রপাতেও পরিলক্ষিত হইতেছে, যাহা উদ্বেগের কারণ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। বজ্রপাত আগেও হইত; কিন্তু ইহার সংখ্যা এতই বাড়িয়াছে যে, দেশে প্রতিবত্সর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ প্রাণ হারাইতেছে। রবিবার রাজধানীর কাকরাইলের আইডিবি ভবনে ‘বজ্রপাতজনিত ভয়াবহতা মোকাবিলায় করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় আলোচকদের বক্তব্যে সেই চিত্র ফুটিয়া উঠিয়াছে। ঐ আলোচনায় তুলিয়া ধরা হইয়াছে—দেশে ২০১৫ সালে ২৭৪ জন, ২০১৬ সালে ৩৮৭ জন, ১৭ সালে ৩৭২ জন এবং ১৮ সালে ৪৪৯ জন মানুষ প্রাণ হারাইয়াছে। লক্ষ্য করিলেই দেখা যাইবে যে, প্রতিনিয়তই এই মৃত্যুর হার বাড়িতেছে। উল্লেখ্য, রবিবারই চাঁদপুর জেলায় এক বজ্রপাতে একই পরিবারের চার সদস্যসহ সারাদেশে ৯ জন প্রাণ হারাইয়াছে। 

বজ্রপাত একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের অংশ; কিন্তু আমাদের দায় প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করিয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগাদির সহিত পাশাপাশি বসবাস করা। বিগত দিনে মৃত্যুর হার কম থাকিবার কারণ কেবল জলবায়ু পরিবর্তনই নহে। পূর্বে সমতল এই ভূমির প্রায় সর্বত্রই উঁচু উঁচু তালগাছসহ বড়ো বড়ো পুরানা গাছ দেখা যাইত, যাহা বজ্রপাতকে নিজের মাথায় ধারণ করিয়া মনুষ্য মৃত্যুর হার কমাইয়া রাখিত। আমাদেরই নির্বুদ্ধিতার কারণে সেই গাছ এখন আর নাই। ইহার সহিত জনসংখ্যাও বাড়িয়াছে, দেশ আরো ঘনবসতিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। আমরা লক্ষ করিলেই দেখিব, বজ্রপাতে সর্বাধিক মৃত্যু হইয়া থাকে কৃষকের জমিতে কাজ করিবার সময়। পূর্বে অনেক কৃষি জমির ফাঁকে ফাঁকে তালগাছ, খেজুরগাছ দেখা যাইত। এখন সেই তালগাছ আর কৃষকের জমির মধ্যে দেখা যায় না। অর্থাত্ কেবল প্রকৃতির উপর দোষ চাপানো ঠিক হইবে না। দ্বিতীয়ত, একদিকে যেমন মানুষের মধ্যে বজ্রপাতের সময় করণীয় সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পায় নাই, অন্যদিকে বজ্রপাতের সময় সচেতন করিবার বিশেষ কোনো সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাও নাই। কেবল উপকূলীয় অঞ্চলে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সংকেত ছাড়া দেশের অন্যান্য প্রত্যন্ত অঞ্চলে বজ্রপাতের সম্ভাবনা সম্পর্কে বিশেষ কোনো বার্তা পৌঁছানোর ব্যবস্থা নাই। উন্নত বিশ্বে জেলায় জেলায়, এমনকি ছোটো ছোটো অঞ্চলে কমিউনিটি রেডিও দেখিতে পাওয়া যায়। এইসব রেডিও বাণিজ্যিক হইলেও উহারা আবহাওয়া সংবাদসহ সামাজিক কিছু সেবাও দিয়া থাকে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, উন্নত দেশগুলির একটি হাইওয়ে দিয়া যখন একটি গাড়ি চলিতে থাকে, তখন রেডিও সিস্টেম অন করা থাকিলে দুই-চার মাইল যাইতে না যাইতে স্টেশন পরিবর্তন হইয়া যায়। ইহার সহিত ঐ অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশসহ সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে রেডিওতে সব তথ্যই পাওয়া যায়। বাংলাদেশে ঢাকা ও তার আশপাশের অঞ্চল ব্যতীত বাণিজ্যিক রেডিও দেখিতে পাওয়া যায় না, কমিউনিটি রেডিও তো দূরের কথা। কেবল বাংলাদেশ বেতারের পক্ষে ৬৮ হাজার গ্রামের বজ্রপাতের সংবাদ পরিবেশন সম্ভব নহে। মোদ্দা কথা, বজ্রপাত হইতে নিরাপদ থাকিতে দেশব্যাপী তালগাছসহ উঁচু গাছের অপরিহার্যতা অনুভূত হইতেছে যাহা আমরা নিজেরাই ধ্বংস করিয়াছি। প্রকৃতি মাঝে মধ্যে বৈরি হইবেই। ইহা হইতে নিজেদের রক্ষায় প্রকৃতিরই সাহায্য লইতে হইবে। তাহার সহিত বাড়িতে বাড়িতে বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্র বা আর্থিংয়ের ব্যবস্থা করিতে হইবে।