শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

লোকোমোটিভের বয়স কত!

আপডেট : ০৭ অক্টোবর ২০১৯, ২১:২৬

বর্তমানে দেশে রেল দুর্ঘটনায় জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হইতেছে। শিডিউল তথা সময়সূচি বিপর্যয়ও নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হইয়াছে। ইঞ্জিনের ব্রেক ফেল হওয়ায় চলিতে চলিতে হঠাত্ ট্রেন বিকল হইয়া যাইতেছে। ইহার মূল কারণ রেলের লোকোমোটিভ তথা ইঞ্জিনসংকট। বাংলাদেশ রেলওয়েতে বর্তমানে ২৬২টি লোকোমোটিভ রহিয়াছে। তন্মধ্যে ২০৬টি তথা ৭৭ শতাংশই মেয়াদোত্তীর্ণ। খুব বেশিদিনের কথা নহে। গত বৃহস্পতিবার রংপুর কাউনিয়ায় মেইল ট্রেন ‘সেভেন আপ’ দুর্ঘটনায় নিপতিত হইলে এক কলেজছাত্র নিহত হন ও আহত হন ৩০ জন। তদন্ত করিয়া দেখা যায়, ইহাতে ইঞ্জিনের ব্রেক ফেল হইয়াছিল এবং এই ইঞ্জিনটির আয়ুষ্কাল শেষ হইয়াছে বহু আগেই। চলতি বত্সরের ২৩ জুন ঢাকা-সিলেট পথে কুলাউড়ায় উপবন এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় ছয় জন নিহতসহ আহত হন অর্ধশত যাত্রী। এই ট্রেনটির ইঞ্জিন ও বগির আয়ুষ্কাল শেষ হইয়াছে ৪০ বত্সর আগেই। মেরামতের মাধ্যমে জোড়াতালি দিয়া চালানো হইতেছিল। এভাবে শুধু পূর্বাঞ্চল রেলওয়েতে গেল বত্সর ১৫৫ বার ইঞ্জিন ফেল হইয়াছে বলিয়া জানা যায়।

কেবল ইঞ্জিন নহে, ট্রেনের অধিকাংশ বগিই পুরাতন ও জরাজীর্ণ। সূত্রমতে, ৩৫৮টি ট্রেনে ১৬২১টি কোচ রহিয়াছে যাহার ৮০ শতাংশই মেয়াদোত্তীর্ণ। এমন পুরাতন ইঞ্জিন-বগিও রহিয়াছে বিশ্বের কোথাও যাহার যন্ত্রাংশ পাওয়া যায় না। ব্রিটিশ আমলে ট্রেন চলিত বাষ্পীয় ইঞ্জিনে। ১৯৫৩ সালে রেলে প্রথম ডিজেল চালিত লোকোমোটিভ যুক্ত হয়। এমইজি-১১ মডেলের আমেরিকান ইঞ্জিন রেলওয়ে বহরে যুক্ত হয় ১৯৫৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর। সেসব ইঞ্জিনের ৮টি এখনও ব্যবহার করা হইতেছে। আমাদের ট্রেন চলাচল যদি স্বাভাবিক রাখিতে হয়, তাহা হইলে অন্তত ১৫০টি লোকোমোটিভ ও শতাধিক যাত্রীবাহী বগি এখনই প্রয়োজন; কিন্তু এই ব্যাপারে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের জোরালো কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হইতেছে না। ২০১২ সালে ৭০টি লোকোমোটিভ ক্রয়ের উদ্যোগ নেওয়া হইলেও নানা জটিলতায় তাহা আলোর মুখ দেখে নাই। এই অবস্থা যদি চলিতেই থাকে, তাহা হইলে রেলওয়েতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি ও আশঙ্কা বাড়িতেই থাকিবে।

জানা যায়, গত ১০ বত্সরে রেলের বহরে ৪৬টি ইঞ্জিন যুক্ত হইয়াছে। ইহা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। তাহাছাড়া এইগুলি আসিয়াছে ইহার আগে বিভিন্ন সময়ে নেওয়া উদ্যোগের কারণে। সৈয়দপুরে যে রেল কারখানা রহিয়াছে, তাহার প্রত্যাশিত উন্নয়নও হয় নাই। অথচ গত পাঁচ বত্সরে রেল খাতে ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ হইয়াছে। ১০ বত্সরে এই অঙ্কটি ৬৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। আমাদের রেলের উন্নয়নের লক্ষ্যে ভারতীয় অর্থায়নও রহিয়াছে; কিন্তু ইহার সিংহভাগ অর্থ পুরাতন ভবন ভাঙিয়া নূতন স্টাইলের ভবন নির্মাণ, স্টেশনগুলি রি-মডেলিং করা এবং রেলপথ মেরামত ও পুনর্নির্মাণে ব্যয় করা হইয়াছে। এখন ইঞ্জিন ও বগি সংকটের সমাধানের দিকে অধিক নজর দেওয়া উচিত। কেননা ট্রেনকে আমরা কিছুতেই মৃত্যুফাঁদ বানাইতে পারি না। পৃথক রেলওয়ে মন্ত্রণালয় গঠনের পরও সবচাইতে বেশি সম্পত্শালী সরকারি সংস্থা রেলওয়েকে কেন লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা যাইবে না? রেলের উন্নয়ন ও আমূল পরিবর্তনের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে ৩০ বত্সর মেয়াদি (২০১৬-৪৫) মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হইয়াছে। ইহার মাধ্যমে সবকয়টি জেলাকে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনাসহ ইলেকট্রনিক ও বুলেট ট্রেনও চালু করা হইবে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। তবে লোকোমোটিভের মতো মৌলিক সমস্যার সমাধানে অবশ্যই অগ্রাধিকার প্রদান করিতে হইবে।