বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

মফস্সলে স্বাস্থ্যসেবার হালচাল

আপডেট : ১৩ অক্টোবর ২০১৯, ২১:৩০

টেকনিশিয়ানের অভাবে অচল পড়িয়া আছে এক্সরে যন্ত্র। নাই ডেন্টাল ও ল্যাব টেকনিশিয়ান। যাত্রা শুরুর পর গত ১৭ বত্সরে হয় নাই জটিল অস্ত্রোপচার ও প্রসূতিদের সিজারিয়ান অপারেশন। নয়টি চিকিত্সকের পদ থাকিলেও কাগজে-কলমে পাঁচ জন কর্মরত আছেন। তন্মধ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকায় চার জন চিকিত্সক দিয়াই চলিতেছে চিকিত্সাসেবা। এমন বেহাল দশা ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের। ৩১ শয্যার হাসপাতালে প্রতিদিন ২০০ রোগী চিকিত্সার জন্য আসে। চিকিত্সা পাইতে চরম দুর্ভোগ পোহাইতে হয় তাহাদের। কিছুদিন আগেই এই সংবাদ প্রকাশিত হইয়াছে এবং এই বাস্তবতা প্রায় সর্বত্র। সংবাদপত্রের পাতায় কিংবা টিভি খুলিলেই দেখা যায় ‘চিকিত্সাসেবা পাতালে’, ‘চিকিত্সাসেবার বেহাল অবস্থা’, ‘অভিজাত হাসপাতালগুলি বাণিজ্য নিয়া ব্যস্ত’, ‘সরকারি হাসপাতালে বেহাল দশা’, ‘সাধারণ মানুষ জিম্মি’, ‘টাকা দিয়াও চিকিত্সা মিলে না’ ইত্যাদি চাঞ্চল্যকর অপ্রিয় সংবাদ। রোগী বা জনগণের বিরাট অংশই ডাক্তার এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতি কমবেশি ক্ষুব্ধ। তাহাদের অভিযোগ পাহাড়সম।

দেশে প্রতি বত্সরই সরকারি খরচে তৈরি হইতেছে একের পর এক ক্লিনিক ও হাসপাতাল। স্বাস্থ্য খাতে সরকার প্রতি বত্সর শত শত কোটি টাকা ব্যয় করিতেছে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রসহ প্রতিটি ইউনিয়নে কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করিয়াছে। দেশের ৯৯ ভাগ উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে আছে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা। অথচ ইউনিয়ন পর্যায়ে স্থাপিত এই সকল স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র, কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিক চলিতেছে অনেকটা নামেই। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো অনিয়ম ও দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিকে দীর্ঘদিন ধরিয়াই ডাক্তার, নার্স, অ্যাম্বুলেন্স, চিকিত্সা সরঞ্জাম ও ঔষধসংকট বিরাজ করিতেছে। কাগজে-কলমে এক জন করিয়া মেডিক্যাল অফিসার নিযুক্ত থাকিলেও অধিকাংশ সময়ই সেখানে রোগী দেখেন না। প্রতিটি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে একজন এমবিবিএস ডাক্তার, একজন ফার্মাসিস্ট, একজন উপসহকারী কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসার ও একজন অফিস সহায়কের পদ আছে। কিন্তু বেশির ভাগ ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এমবিবিএস ডাক্তার ও ফার্মাসিস্ট নাই। বস্তুত অধিকাংশ জেলা উপজেলাতেই বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের মারাত্মক সংকট রহিয়াছে। ঢাকায় ও পার্শ্ববর্তী জেলাগুলিতে এই সমস্যা না থাকিলেও উত্তরাঞ্চল এবং দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলিতে অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পদ শূন্য। দেশের ২ কোটি মানুষ ভুগিতেছেন কোনো না কোনো কিডনি জটিলতায়। কিন্তু এত রোগীর বিপরীতে কিডনি বিশেষজ্ঞের সংখ্যা ২০০ জনেরও কম। এভাবেই চলিতেছে বিভিন্ন জেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলি। সরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে বিরাজ করিতেছে আয়া, দারোয়ানসহ চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের রাজত্ব। ফলে গ্রামীণ বিপুল দরিদ্র জনগোষ্ঠী চিকিত্সাসেবা হইতে বঞ্চিত।

অনেক সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের অর্জন কম নহে। স্বাস্থ্যবিষয়ক সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিস্ময়কর, প্রশংসিত হইয়াছে জাতীয়ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। সীমিত সম্পদ, দারিদ্র্য, জনসংখ্যার আধিক্য সত্ত্বেও বাংলাদেশের এই অর্জন অনুকরণীয়। স্বাস্থ্য ও চিকিত্সাসেবার উন্নয়নে আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন, নূতন হাসপাতাল চালু ইত্যাদি উন্নয়নমূলক অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করিয়াছে সরকার। বর্তমান সরকারের গত মেয়াদে ১৩ হাজার চিকিত্সক, ১৫ হাজার নার্স এবং ১৬ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেওয়া হইয়াছে। এক বত্সরের নিচে ও ৬৫ বত্সরের বেশি বয়সি নাগরিককে সরকার বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করিবে। তবু আমরা জানি, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা এখনো অনেকটাই জেলা ও বিভাগকেন্দ্রিক। উপজেলা পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকসহ উন্নত চিকিত্সার ব্যবস্থা নাই। কিন্তু জটিল জটিল অসংক্রামক রোগে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বাড়িয়াছে। চিকিত্সা ব্যয় ও ঔষুধের দামও অনেক বাড়িয়াছে। সুস্বাস্থ্য এখনো দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিশেষত বস্তিবাসীদের নাগালের বাহিরেই রহিয়া গিয়াছে। আমরা মনে করি,  কেবল মহানগরগুলিতে তাকাইয়া থাকিলে চলিবে না, মফস্সলের হাসাপাতাল ও ক্লিনিকগুলির যথাযথ অবকাঠামো ও জনবল নিশ্চিত করিতে সুপরিকল্পিত কর্মসূচি লইতে হইবে।