বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

পথশিশুদের অসহায়ত্ব ও পুনর্বাসন

আপডেট : ১৪ অক্টোবর ২০১৯, ২১:১৮

আমরা প্রায়শ বলিয়া থাকি শিশুরা জাতির ভবিষ্যত্। এমনকি কবির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলাইয়া বলিয়া থাকি—‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে’। এইভাবে দেশ ও জাতি গঠনে প্রত্যেক শিশুর শারীরিক-মানসিক বিকাশের গুরুত্ব অনুধাবন করিলেও অনেক সময় আমাদের বাস্তব কাজেকর্মে তাহার প্রতিফলন লক্ষ করা যায় না। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ শিশু। কিন্তু এই শিশুদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই সুবিধাবঞ্চিত। তন্মধ্যে পথশিশুদের অবস্থা আরো করুণ ও শোচনীয়। ইউনিসেফের মতে, যেই সকল শিশুর জন্য রাস্তা বসবাসের স্থান অথবা জীবন-জীবিকার উপায় বা অবলম্বন হইয়া গিয়াছে তাহারাই পথশিশু। তাহাদের কেহ কেহ ব্রোকেন ফ্যামিলি তথা ভাঙিয়া যাওয়া পরিবার হইতে বাহির হইয়া আসে। কেহ কেহ নদীভাঙন বা অভাব-অনটনের শিকার। তাহাদের দেখা মিলে বিভিন্ন শহরের রাস্তা, পার্ক, বাস বা রেল স্টেশন অথবা খোলা কোনো জায়গায়। কেহ কেহ সরকারি-বেসরকারি সংস্থার অধীনে থাকিয়া একসময় সমাজের মূল স্রোতে যুক্ত হয়। কেহ কেহ মাদকাসক্ত হইয়া পথেই মারা যায় বা অপরাধীচক্রের খপ্পরে পড়িয়া নির্যাতিত হয় অথবা বিদেশে পাচার হইয়া যায়। এইসব শিশুকে রক্ষা করা যেমন রাষ্ট্রের দায়িত্ব, তেমনি নাগরিকদেরও দায়িত্ব কম নহে।

এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা ২০ লক্ষ। কাহারও মতে, ২৫ লক্ষ। শুধু ঢাকা শহরে আছে কমপক্ষে ৬-৭ লক্ষ। সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক এনহান্সমেন্ট প্রোগ্রাম (সিপ) নামের একটি সংস্থার মতে, পথশিশুদের প্রায় ৪৪ শতাংশ মাদকাসক্ত, ৪১ শতাংশের ঘুমাইবার কোনো বিছানা নাই, ৪০ শতাংশ শিশু গোসল করিতে পারেন না, ৩৫ শতাংশ শিশু উন্মুক্ত স্থানে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয় এবং ৫৪ শতাংশ অসুস্থ হইলে দেখিবার কেহ নাই। তাহারা এইভাবে অনাদরে ও অবহেলায় থাকিয়া মানবেতর জীবন যাপন করিতে পারে না। বীজের মধ্যে যেমন ফসলের সম্ভাবনা, তেমনি এইসব শিশুর মধ্যেও রহিয়াছে দেশ মাতৃকার উন্নতি, সমৃদ্ধি ও প্রগতির সম্ভাবনা। এইজন্য পথশিশুদের পুনর্বাসনের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

আশার কথা হইল, সম্প্রতি আন্তর্জাতিক শিশু দিবস উপলক্ষ্যে শিশু একাডেমিতে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বলিয়াছেন যে, দেশের সব জেলা ও উপজেলায় নির্মিত হইবে পথশিশু পুনর্বাসন কেন্দ্র। দেশের কোনো পথশিশু আর পথে থাকিবে না। ইহার আগে প্রধানমন্ত্রীও এমন প্রতিশ্রুতি দিয়াছেন। তবে এই সকল পথশিশুর উত্সমুখ বন্ধে সর্বাগ্রে বিশেষ ক্যাম্পেইন বা জনসচেতনতা দরকার। পথেঘাটে অভিভাবকহীন শিশু দেখামাত্রই স্থানীয় প্রশাসনের উচিত তাহাদের উদ্ধার করিয়া কোনো আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানো। আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদের ২০ নম্বর অনুচ্ছেদের উপধারা (১) এবং বাংলাদেশ শিশু আইন-১৩-এর ৮৯ অনুচ্ছেদে ১৬টি ক্যাটাগরিতে সুবিধাবঞ্চিত শিশুর অধিকার রক্ষার কথা বলা হইয়াছে। তাহাদের সুবিধার্থে ১৯৮৯ সালে তত্কালীন সরকার গঠন করে পথকলি ট্রাস্ট। পরে সরকার পরিবর্তন হইলে নাম বদলাইয়া গঠন করা হয় শিশু কল্যাণ ট্রাস্ট। কিন্তু নাম বদলাইলেও পথশিশুদের অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন নাই। কারণ ইউনিসেফ বলিতেছে, গত এক দশকে আমাদের পথশিশুর সংখ্যা বাড়িয়া দ্বিগুণ হইয়াছে। এমনকি পথশিশু প্রকল্পে বিদেশি দাতা সংস্থাগুলোর অর্থায়নও কমিয়া গিয়াছে ৪০ শতাংশ। এই সার্বিক পরিস্থিতির কারণে পথশিশুদের অসহায়ত্ব বাড়িতেছে যাহার অবসান একান্ত কাম্য।