বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার হত্যাকাণ্ডে গোটা দেশে তোলপাড় শুরু হইলে বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ হইতে শুরু করিয়া আন্তর্জাতিক সংস্থা পর্যন্ত নানাবিধ মত প্রকাশ করিয়াছে, মন্তব্য ছুড়িয়া দিয়াছে। কিন্তু তাহার মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের মন্তব্যটি ছিল সর্বাধিক প্রাসঙ্গিক, গুরুত্বপূর্ণ ও প্রণিধানযোগ্য। ১১ অক্টোবর তিনি আবরার হত্যায় দুঃখ প্রকাশ করিয়া বলিয়াছিলেন, ‘বুয়েট প্রশাসন সতর্ক থাকিলে হয়তো আবরার হত্যাকাণ্ড ঘটিত না।’ যথার্থই বলিয়াছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনিই ইহা বলিতে পারেন। তাহার এই বক্তব্যের মধ্যে দায়িত্বশীলতার প্রতি ইঙ্গিত রহিয়াছে। বক্তব্যটি গোচরে লইবার দায়িত্ব বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সংস্থার দায়িত্বশীলদের উপরেই বর্তায়। সাবেক ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেগ বলিয়াছিলেন, ‘একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কথা বলিবেন ভিকটিমের পক্ষে, ক্রিমিনালের পক্ষে নহে। ইহাই তাহার দায়িত্ব।’ আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও তাহাই করিয়াছেন। তিনি দীর্ঘকাল ধরিয়া দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রহিয়াছেন। এই স্পর্শকাতর মন্ত্রণালয়টির দায়িত্ব দীর্ঘকাল যাবত্ সুনামের সহিত পালন করা সহজ কথা নহে। বর্তমানে কেবল বাংলাদেশেই নহে, গোটা বিশ্বে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। খোদ যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক দিন যাইতে না যাইতে আমরা ম্যাস শুটিং দেখিতে পাই। এই শতাব্দীতেই যুক্তরাষ্ট্রে ম্যাস শুটিংয়ে কয়েক শত লোক নিহত হইয়াছে। তাহার উপর রহিয়াছে সিরিয়াল কিলার, রেপিস্ট, ছিনতাইকারীর দ্বারা হত্যার অসংখ্য ঘটনা। নিউ ইয়র্ক, শিকাগোর মতো বহু শহরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ প্রশাসনকে হিমশিম খাইতে হইতেছে। আইনের দেশ জার্মানিতে ৯ অক্টোবর আক্রমণকারীর হামলায় নিহত হইয়াছে দুই জন। দেশটির ট্রেনে, বাসে হামলার ঘটনা ঘটিতেছে প্রায়শই। ১৪ অক্টোবর যুক্তরাজ্যের ইয়র্কশায়ার কারাগারের অভ্যন্তরে নিহত হইয়াছেন ২০০ শিশুকে ধর্ষণকারী রিচার্ড হাকল নামের এক কয়েদি। যুক্তরাজ্য সরকারের সর্বশেষ এক হিসাবে দেখা যায়, কেবল ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসে ২০১৫ সালে ৬ লক্ষ ১৮ হাজার ‘ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট পারসন’ অপরাধ রেকর্ড করা হইয়াছে। ইহা বিশ্বের সবচাইতে সভ্য বলিয়া বিবেচিত দেশের হিসাব। অন্য দেশগুলির হিসাবের খাতা আরো অনেক দীর্ঘ।
আমাদের দেশ ছোটো নহে। ১৬-১৭ কোটি মানুষের দেশ। তাহার উপর রহিয়াছে নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা। প্রশাসনের রহিয়াছে লজিস্টিক সাপোর্টের অভাব, মানুষের রহিয়াছে সুশিক্ষার অভাব; রহিয়াছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা সম্পর্কে অসচেতনতা। সেই বিচারে বাংলাদেশের পরিস্থিতি খারাপ বলার কোনো সুযোগ নাই। আমাদের দেশেও বিচ্ছিন্নভাবে অপরাধ সংঘটিত হইতেছে বটে, কিন্তু তাহাকে কোনোক্রমেই ‘উদ্বেগজনক’ বলা যায় না। বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথমে প্রতিমন্ত্রী এবং পরে পূর্ণমন্ত্রী হিসাবে এই দপ্তরে পাঁচ বত্সরাধিক কাল কাটাইয়া দিয়াছেন। এই সময়ের মধ্যে অসংখ্য নির্বাচন সংঘটিত হইয়াছে যাহা তিনি শান্তিপূর্ণভাবে উত্তরণ ঘটাইতে সক্ষম হইয়াছেন। সন্ত্রাস মোকাবিলায় তিনি যাহার পর নাই সফল হইয়াছেন। আমরা ইতিহাস হইতে দেখিয়া আসিয়াছি, বিরোধী দল, সমাজের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় সর্ববিষয়ে পান হইতে চুন খসিলেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি বিষোদ্গারে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছেন। কিন্তু লক্ষ্যণীয়, বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাহার দায়িত্বপালনের এই সুদীর্ঘকালে সেই সুযোগ কাহাকেও দেন নাই। সর্বমহলে তাহার একটি পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি রহিয়াছে, গ্রহণযোগ্যতা রহিয়াছে। সুতরাং এই দায়িত্বশীল মন্ত্রীর ওই বক্তব্যকে বিবেচনায় লইতে হইবে। যাহার যাহার প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বশীলদের সতর্ক চোখ রাখিতে হইবে।