শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

এক বিচারকের দৃষ্টান্ত

আপডেট : ১৭ অক্টোবর ২০১৯, ২১:০৬

একটি রায়ে আসামিদেরকে বেকসুর খালাস দিয়া অতঃপর এজলাসে বসিয়াই নিজের বুকে গুলি চালাইয়া থাইল্যান্ডের একজন বিচারক সারা বিশ্বের বিচারক সম্প্রদায়কে তাহাদের দায়িত্বের কথা স্মরণ করাইয়া দিলেন। বিচারক আলখাল্লার ভিতর হইতে পিস্তল বাহির করিয়া বুকে গুলি চালাইবার পূর্বে যে বক্তব্য দিয়াছেন, তাহা বিশ্বব্যাপী বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের অন্তরকে নাড়াইয়া দিয়াছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস, গার্ডিয়ান, রয়টার্স, এএফপি হইতে শুরু করিয়া জাকার্তা পোস্ট, ব্যাংকক পোস্ট পর্যন্ত বিস্তারিত জানাইয়াছে। ঘটনায় প্রকাশ, থাইল্যান্ডে দক্ষিণাঞ্চলের ইয়ালা প্রদেশে রহিয়াছে বিদ্রোহের অভিযোগ, সন্ত্রাসী তত্পরতার অভিযোগ। সেই রকম একটি অভিযোগে পাঁচজন মুসলমানকে একটি খুনের মামলায় গ্রেফতার করিয়া সন্দেহভাজন হিসাবে আদালতে সোপর্দ করা হয়। থাইল্যান্ডের সেনাবাহিনীর ইচ্ছা পূরণ করিতে ঐ অঞ্চলের রিজিওনাল চিফ জাস্টিস চাপ প্রয়োগ করিতে থাকেন ইয়ালার বিচারক কানাকর্ন পিয়াঁচানার প্রতি, যাহাতে ঐ পাঁচ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু মৃত্যুদণ্ড না দিয়া কানাকর্ন উহাদের বেকসুর খালাস দেন। উল্লেখ্য, থাইল্যান্ডের ঐ অঞ্চল পূর্বে মালয় মুসলিম সালতানাতের অধীন ছিল। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে উহা থাইল্যান্ডের অধিকারভুক্ত হয়। সেই সময় হইতেই ওই অঞ্চলে থাই মুসলমানদের বসবাস রহিয়াছে।  

রায় প্রদান শেষে ১৭ বত্সর যাবত্ বিচারকার্যে নিয়োজিত বিচারক কানাকর্ন বক্তব্য দিয়া বলেন, ‘আমার কথাগুলি হয়তো পাখির পালকের মতো নরম শোনাইবে, কিন্তু আমার হূদয় পাহাড়ের মতো ভারী হইয়া আছে। আমি ইহা নিশ্চিত করিয়া বলিতেছি না যে, যাহাদের খালাস দিলাম তাহারা অপরাধ করেন নাই। কিন্তু তাহাদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ নাই। কাউকে শাস্তি দিতে হইলে তাহার বিরুদ্ধে নিশ্চিত তথ্যপ্রমাণ থাকিতে হইবে। বিচারিক প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হইতে হইবে। ভুল মানুষকে শাস্তি দিলে তাহাদেরকে বলির পাঁঠা করা হইবে। এখন একটি সংকট চলিতেছে, যখন মানুষ বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা হারাইয়া ফেলিয়াছে। আজ যদি আমি রিজিওনাল জাস্টিসের আদেশ অনুসরণ করি, তাহা হইলে আমি কোনো ভালো জজ নহি, উহা হইবে বিচারক হিসাবে আমার শপথের বরখেলাপ। ইহাই আমার শেষ কথা। আমি আমার রায় পরিবর্তন করিব না। কারণ এই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হইবে ভয়ানক মন্দ কর্মা (বৌদ্ধধর্মে কোনো কাজ-সম্পর্কিত অ্যাকশনকে কর্মা বলা হয়)। মর্যাদাহীন জীবনের চাইতে বরং মৃত্যুই শ্রেয়।’ ইহার পরই তিনি নিজের বিচারকের পোশাকের ভেতর হইতে পিস্তল বাহির করিয়া নিজের বুকে গুলি চালান। জানা গিয়াছে, বিচারকার্য শুরু করিবার পূর্বে তিনি একটি ফেসবুক পোস্টে লিখিয়াছিলেন, ‘একটি মামলায় উদ্দেশ্যমূলক রায় প্রদানের জন্য আমাকে চাপ দেওয়া হইতেছে।’

আমরা জানি, এই ঘটনায় বিশ্বে কোনো পরিবর্তন আনিবে না। থাইল্যান্ড যেইভাবে চলিতেছিল সেইভাবেই চলিবে। কিন্তু বিচারক কানাকর্ন পিয়াঁচানা এজলাসের উপর বসিয়া অদৃশ্য অন্যায়ের বাস্তবতার বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ করিলেন তাহা একটি দৃষ্টান্ত হইয়া থাকিবে। তিনি বুঝাইয়া দিয়াছেন, বিচারক হিসাবে যে শপথ তিনি লইয়াছিলেন, তাহা জীবন দিয়া হইলেও রক্ষা করা তাহার দায়।