আজ ৭ ডিসেম্বর। বাংলায় পুরোদমে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এ সময় যুদ্ধ পরিস্থিতির বিবরণ দিয়ে জেনারেল নিয়াজি গোপন বার্তা পাঠিয়েছিলেন রাওয়ালপিন্ডির হেডকোয়ার্টার্সে। রিপোর্টে তিনি উল্লেখ করেন, চারটি ট্যাংক রেজিমেন্ট সমর্থিত আট ডিভিশন সৈন্য নিয়ে আক্রমণ শুরু করেছে ভারত। তাদের সঙ্গে আরো আছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৬০ থেকে ৭০ হাজার বিদ্রোহী (মুক্তিযোদ্ধাদের পাকিস্তানিরা তখন বিদ্রোহী বলে উল্লেখ করত)। তিনি আরো লেখেন, ‘স্থানীয় জনগণও আমাদের বিরুদ্ধে। দিনাজপুর, রংপুর, সিলেট, মৌলভিবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লাকসাম, চাঁদপুর ও যশোরে প্রবল চাপের মুখে রয়েছে সৈন্যরা। পরিস্থিতি নাজুক হয়ে উঠতে পারে।’ তিনি লেখেন, ‘গত নয় মাস জুড়ে আমাদের সৈন্যরা কার্যকর অপারেশনে নিয়োজিত ছিল এবং এখন তারা তীব্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। গত ১৭ দিনে যেসব খণ্ড যুদ্ধ হয়েছে, তাতে জনবল ও সম্পদের বিচারে আমাদের ক্ষয়ক্ষতি বেড়ে গেছে। অস্ত্রসহ রাজাকারদের সটকে পড়ার সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের নিজেদের ট্যাংক, ভারী কামান ও বিমান সমর্থন না থাকার ফলে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটেছে।’ গোপন এ বার্তা পেয়ে হেডকোয়ার্টার্স থেকে ৭ ডিসেম্বর সম্মুখসমরের সৈন্যদের পিছিয়ে এনে প্রতিরোধ ঘাঁটিতে সমবেত করার জন্য নিয়াজির পরিকল্পনা অনুমোদন প্রদান করা হয়। তবে অনুমোদনের অপেক্ষায় বসে থাকেনি যশোর ক্যান্টনমেন্টের পাকিস্তানি বাহিনী। শক্তপোক্ত ঘাঁটি ছেড়ে তারা ৬ ডিসেম্বর রাতের অন্ধকারেই পালিয়ে যায়। একদল যায় ফরিদপুর-গোয়ালন্দের দিকে। আর বড়ো দলটি যায় খুলনার দিকে। ব্রিগেডিয়ার হায়াত তখন ঢাকার দিকে না গিয়ে বস্তুত খুলনার দিকে একরকম পালিয়েই গিয়েছিলেন।
এদিন বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ ভারতীয় নবম ডিভিশনের প্রথম কলামটি উত্তর দিক দিয়ে যশোর ক্যান্টনমেন্টের কাছে এসে পৌঁছায়। মিত্রবাহিনীর জেনারেল রায়নার নেতৃত্বাধীন নবগঠিত সেকেন্ড কর্পস জলাভূমিবেষ্টিত ক্যান্টনমেন্টটিতে আক্রমণ করতে সৈন্যরা ভারী গোলাবর্ষণ ও বিমান হামলা চালিয়ে আক্রমণ উপযোগী করে নিয়েছিল। আক্রমণের সকল আয়োজন সম্পন্ন করে মিত্রবাহিনী দেখে পাকিস্তানি বাহিনী আগেই যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পালিয়েছে। পলায়নের সময় হানাদার বাহিনী বিপুল অস্ত্রশস্ত্র, রেশন এবং কন্ট্রোল রুমের সামরিক মানচিত্রও ফেলে রেখে যায়। পাকিস্তানি বাহিনীর পলায়নের মধ্য দিয়ে ৭ ডিসেম্বর যশোরের এই মুক্ত হওয়াটা সারাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছিল কয়েক গুণ। যশোরের মুক্তি বিশ্ব মিডিয়ারও মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল ব্যাপকভাবে।
এদিন ভোরে ভারতীয় ছত্রীসেনা সিলেটের নিকটবর্তী বিমানবন্দর শালুটিকরে নামে। তারপর চতুর্দিক থেকে পাকিস্তানি ঘাঁটিগুলির ওপর আক্রমণ চালায়। দুপুর বেলাতেই এখানকার পাকিস্তানি সেনানায়ক আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
এদিন যৌথ বাহিনী চান্দিনা ও জাফরগঞ্জ অধিকার করে। বিকালের দিকে বগুড়া-রংপুর সড়কের করতোয়া সেতু দখল নিয়ে পাকিস্তান ও যৌথ বাহিনীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়।
এদিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে অর্থনৈতিক সাহায্যদান বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। আর সোভিয়েত নেতা রিওনিদ ব্রেজনেভ কোনো রকম বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপ ছাড়া পাক-ভারত সংঘর্ষের একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানান।