শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ব্যাপকভিত্তিক পরীক্ষা জরুরি

আপডেট : ২৮ মার্চ ২০২০, ২২:৪০

বাংলাদেশে করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা অতি দ্রুত ব্যাপক হারে করা জরুরি। নইলে যে কোনো মুহূর্তে ভাইরাসটির ব্যাপকতা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বারবার তাগিদ দিয়ে বলছে, ‘সব দেশের প্রতি আমাদের উপদেশ, ‘পরীক্ষা, পরীক্ষা, পরীক্ষা’। মানে করোনা আক্রান্ত হিসেবে কাউকে সন্দেহ হলে প্রথম কাজ হলো পরীক্ষা করানো। ডব্লিউএইচও কোনো দেশের নাম উল্লেখ করেনি। তবে এই বার্তা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশের জনঘনত্ব ও এখানকার মানুষের জীবনযাপনের ধরন বিবেচনায় নিয়ে অনেক বিশেষজ্ঞই বাংলাদেশকে উচ্চ ঝুঁকির দেশ হিসেবে বিবেচনা করছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, করোনা ভাইরাস মোকাবিলার মূল পথ হচ্ছে সংক্রমণ শনাক্ত করা, তাদের বিচ্ছিন্ন করা এবং সংক্রমিতরা কাদের সংস্পর্শে এসেছে, তাদের খুঁজে বের করে কোয়ারেন্টাইনে রাখা। বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস পরীক্ষার একক ও একমাত্র কর্তৃত্ব রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর)। ১৭ কোটি লোকের এই দেশে কারো মধ্যে করোনা ভাইরাসের লক্ষণ দেখা গেলে এই প্রতিষ্ঠানের দেওয়া কিছু ফোন নম্বরে ফোন করতে হয়। তাদের কিছু প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব পেলে পরীক্ষা করা হয়। সম্প্রতি বিদেশে থেকে দেশে এসেছে ৭ লাখ মানুষ। কিন্তু পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৬৮ জনের। এই ৭ লাখ মানুষ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা কত লাখ মানুষের সংস্পর্শে গেছে তার কোনো হিসাব নেই। এ কারণে সামাজিক সংক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। ঢাকায় আন্তর্জাতিকমানের একটি হাসপাতালসহ দুটি হাসপাতালের চিকিত্সক ও স্বাস্থ্য কর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। যারা বিদেশফেরত নয়, আবার বিদেশফেরতদের সংস্পর্শেও যাননি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ জানান, অজ্ঞাত কোনো মানুষ যদি করোনা বহন করে সবার সঙ্গে চলাফেরা ও মেলামেশা করে, তাহলে ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। দ্রুত শনাক্ত করা গেলে দেশ রক্ষা পাবে, ডাক্তার-নার্স রক্ষা পাবেন, জনগণ রক্ষা পাবে। আমরা কেউই সুরক্ষিত নই। শনাক্তকরণ ব্যবস্থা জোরদার করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। ডা. খান আবুল কালাম আজাদ বলেন, তাদের পরীক্ষার ল্যাবরেটরি আছে, কিন্তু আনুষঙ্গিক যন্ত্রাংশের অভাব রয়েছে। তবে যন্ত্রপাতি দেওয়া হচ্ছে। দ্রুত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে করোনা ভাইরাসের পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। 

কারো মধ্যে লক্ষণ দেখা গেলেই তাকে পরীক্ষা করতে হবে এবং নিশ্চিত হতে হবে তিনি সংক্রমিত কি না। এটাই এই ভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণ ঠেকানোর পথ। কারণ, তখনই তাকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে, তার সংস্পর্শে আসা লোকজনকে কোয়ারেন্টাইন করা যাবে। এ কারণে বিলম্বে হলেও শনাক্তকরণ কার্যক্রম জোরদার করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) দু-একদিনের মধ্যে করোনা শনাক্তকরণ কার্যক্রম শুরু হবে। আইইডিসিআরে পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে এই প্রতিষ্ঠানের একার পক্ষে করোনা ভাইরাসের পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়টি সামাল দেওয়া সম্ভব নয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ জানান, ঢাকার বাইরেও শনাক্তকরণ পরীক্ষাগার স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। ঢাকার মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, ঢাকা শিশু হাসপাতাল ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজে শুরু হবে। এরমধ্যে ঢাকা শিশু হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগী যেতে পারবে না, শুধু নমুনা পাঠিয়ে পরীক্ষা করা যাবে। আর ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিকাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিসেস, কক্সবাজার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আইইডিসিআরের ফিল্ড ল্যাবরেটরি,   ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে করোনা শনাক্তকরণ কার্যক্রম শুরুর কাজ চলছে। এদিকে করোনা আক্রান্ত রোগীদের অনেকেরই আইসিইউ প্রয়োজন হয়। কিন্তু সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে মাত্র দুই শতাধিক আইসিইউ বেড রয়েছে। এই বেডগুলো অপারেশন কিংবা সংকটাপন্ন রোগীদের জন্য। কিন্তু করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য যে পূর্ণাঙ্গ আইসিইউ প্রয়োজন, সেটা এই আইসিইউ দিয়ে সামাল দেওয়া সম্ভব না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ জানান, আরো ৩০০ বেডের আইসিইউ প্রস্তুত করা হচ্ছে।  তিনি জানান, প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস দেশে আপাতত নিয়ন্ত্রণে থাকলে দুঃচিন্তামুক্ত থাকার সুযোগ নেই। কারণ এই ভাইরাসটি হঠাত্ লাফিয়ে বাড়ে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইতালিতেও একই অবস্থা ছিল। প্রথমে অল্প সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী, কোভিড-১৯-এর  রোগীদের চিকিত্সাসেবায় নিয়োজিত চিকিত্সক, নার্সসহ সংশ্লিষ্টদের পরিধান করতে হবে বিশেষ পার্সোনাল প্রটেকশন ইক্যুইপমেন্ট (পিপিই)। চিকিত্সক, রোগীর কক্ষে থাকা স্বাস্থ্যসেবা কর্মী, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টসহ প্রতিটি স্তরের পেশাজীবীদের জন্য পৃথক পৃথক পিপিইর কথা বলা হয়েছে।  দেশে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু পর থেকে একাধিক ব্যক্তি, সামাজিক সংগঠন পিপিই তৈরি করছে। কেউ করছে বাণিজ্যিক কারণে, কেউবা আবার স্বেচ্ছায় সহযোগিতা করার জন্য। কিন্তু, ?বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ড, আমেরিকান স্ট্যান্ডার্ড এবং সাম্প্রতিক সময়ে চীনেও একটি স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করা হয়েছে। এ তিন স্ট্যান্ডার্ডের ক্রাইটেরিয়া পূর্ণ হলেই কেবলমাত্র একটি পারফেক্ট পিপিই তৈরি করা সম্ভব।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ইতিমধ্যে এ বিষয়ে লজিস্টিক সাপোর্ট বিষয়ক কমিটি করেছে। কমিটির একাধিক সদস্য বলেন, বিভিন্ন জন পিপিইর অনুমোদন চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যোগাযোগ করছে, কিন্তু যথাযথ স্ট্যান্ডার্ড না মানা হলে আমরা অনুমোদন দিতে পারি না। সম্প্রতি চীন থেকে আন্তর্জাতিক মানের ১০ হাজার পিপিই দেশে এসেছে।

করোনা ভাইরাসে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন কেউ শনাক্ত হননি। আগে আক্রান্ত আরো চার জন সুস্থ হয়েছেন। গতকাল শনিবার সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা এক ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে করোনা ভাইরাস মহামারির সর্বশেষ পরিস্থিতি তুলে ধরে বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় মোট ৪২ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে, নতুন করে কারো মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েনি। আক্রান্তের মোট সংখ্যা আগের মতোই ৪৮ জন আছে। তিনি বলেন, আমরা একটা সুখবর দিতে চাই, যাদের মধ্যে আগে সংক্রমণ হয়েছিল, তাদের মধ্যে আরো চার জনের মধ্যে এখন আর কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ নেই। এ নিয়ে মোট ১৫ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। যারা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন তারা আট থেকে সর্বোচ্চ ১৬ দিন পর্যন্ত হাসপাতালে ছিলেন। তারা মৃদু অসুস্থতায় ভুগছিলেন। তিনি বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় আইইডিসিআরের হটলাইনে কল এসেছে ৩ হাজার ৪৫০টি। এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ১ হাজার ৬৮ জনের। গত ৭২ ঘণ্টায় নতুন করে কারো মৃত্যুর তথ্য না আসায় মৃতের মোট সংখ্যা আগের মতোই পাঁচ জনে রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) পরিচালক ডা. মো. হাবিবুর রহমান বলেন, আগামী সাত থেকে ১০ দিনের মধ্যে সব বিভাগে করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) নমুনা শনাক্ত পরীক্ষা করা হবে। ৬৪ জেলার সবধরনের ল্যাব টেকনিশিয়ানদের ভিডিও কনফারেন্সে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। শনিবার রাজধানীর মহাখালীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস মিলনায়তনে এক ভার্চুয়াল সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।