শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

করোনার টিকা প্রাপ্তিতে ন্যায্যতায় গুরুত্ব দিলেন প্রধানমন্ত্রী

আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ২৩:৩৪

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্ভাব্য কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের সময়োপযোগী সমান প্রাপ্তি নিশ্চিতের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। সম্ভাব্য ভ্যাকসিন প্রাপ্তিতে উন্নত দেশগুলোরভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদএর একটি দৃশ্যমান প্রবণতা দেখা দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, আশা করা হচ্ছে বিশ্ব শিগিগরই কোভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন পাবে। এই ভ্যাকসিনকে বৈশ্বিক সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা প্রয়োজন। কোভিড-১৯ প্রমাণ করেছে, আমাদের সকলের ভাগ্য একই সূত্রে গাঁথা। কাজেই সব দেশ যাতে এই ভ্যাকসিন সময়মতো এবং একই সঙ্গে পায় তা নিশ্চিত করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল শনিবার নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৫তম অধিবেশনে দেশের পক্ষে ভার্চুয়াল ভাষণে আহ্বান জানান। পূর্বে ধারণকৃত এই ভাষণে শেখ হাসিনা দেশের ওষুধ শিল্পের অবকাঠামোগত সক্ষমতার বিষয়টির উল্লেখ করে বলেন, কারিগরি জ্ঞান মেধাস্বত্ব প্রদান করা হলে, এই ভ্যাকসিন বিপুল পরিমাণে উত্পাদনের সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে। বিশ্বস্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রকদের মতে, গবেষকরা মানবদেহে ক্লিনিকাল ট্রায়ালগুলোতে ৪২টি ভ্যাকসিন পরীক্ষা করছেন এবং কমপক্ষে ৯৩টি প্রাক্কলিত ভ্যাকসিন প্রাণীতে সক্রিয় তদন্তাধীন রয়েছে। তিনি বলেন, মহামারি অবসানে আমাদের উদ্যোগ এবং এজেন্ডা-২০৩০ অর্জনে আমাদের প্রচেষ্টা সমানতালে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় ভলান্টারি ন্যাশনাল রিভিউ রিপোর্ট উপস্থাপন প্রমাণ করে যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে আমরা যথাযথভাবে এগিয়ে চলেছি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রতি বছরের মতো এবারো বাংলায় ভাষণ দেন। কোভিড-১৯-এর কারণে জাতিসংঘের ইতিহাসে এই প্রথম নিউ ইয়র্কের সদর দপ্তরে সদস্য দেশসমূহের রাষ্ট্র সরকার প্রধানগণের অনুপস্থিতিতে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

শেখ হাসিনা মহামারি কার্যকরভাবে মোকাবিলায় সঠিক নেতৃত্বের নির্দেশনায়সম্মিলিত ব্যবস্থানেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, করোনা ভাইরাস আমাদের অনেকটাই ঘরবন্দি করে ফেলেছিল। আমরা কেউই সুরক্ষিত নই, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা সকলের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারছি। এর প্রভাবে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পাশাপাশি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে বিদ্যমান বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জসমূহ আরো প্রকট হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মহামারি আমাদের উপলদ্ধি করতে বাধ্য করেছে যে, এসংকট উত্তরণে বহুপাক্ষিকতাবাদের বিকল্প নেই। তিনি বলেন, জাতিসংঘের ৭৫তম বছর পূর্তিতে জাতিসংঘ সনদে অন্তর্নিহিত বহুপাক্ষিকতাবাদের প্রতি আমাদের অগাধ আস্থা রয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে বহু প্রতিকূলতার মধ্যেও বহুপাক্ষিকতাবাদের আদর্শ সমুন্নত রাখতে আমরা বদ্ধপরিকর।

রোহিঙ্গা সমস্যা, জলবায়ু সংকট, কোভিড-১৯-এর কারণে অভিবাসী শ্রমিকদের দুর্দশা, সন্ত্রাসবাদ এবং চরমপন্থার বিরুদ্ধে তার সরকারের গৃহীত জিরো টলারেন্স পলিসি, এসডিজি অর্জনের পদক্ষেপসমূহ, দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের চিত্র, নারীর ক্ষমতায়ন, বহুপাক্ষিকতা এবং বিশ্বশান্তি প্রচেষ্টার নানাদিক তার ১৭ মিনিটের ভাষণে তুলে আনেন প্রধানমন্ত্রী।

দীর্ঘায়িত রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে আরো কার্যকর ভূমিকা নিতে শেখ হাসিনা বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি তার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, এই সমস্যা মিয়ানমারের সৃষ্টি এবং এর সমাধান মিয়ানমারকেই করতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ১১ লাখেরও বেশি জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিককে আশ্রয় দিয়েছে। তিন বছরের বেশি সময় অতিক্রান্ত হলেও এখন পর্যন্ত মিয়ানমার একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেয়নি।

অনেক উন্নত দেশের চেয়ে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ কে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারা এবং সরকার প্রদত্ত নাগরিকদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার তথ্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোভিড-১৯ রোগী শনাক্তের সঙ্গে সঙ্গে আমরা ৩১-দফা নির্দেশনা জারি করেছিলাম। করোনা ভাইরাস যাতে ব্যাপকহারে সংক্রামিত হতে না পারে, তার জন্য আমরা সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানোর পাশাপাশি সুরক্ষাসামগ্রী বিতরণ করেছি। যার সুফল হিসেবে আমরা লক্ষ্য করছি, ঋতু পরিবর্তনের ফলে আমাদের দেশে যেসব রোগের প্রাদুর্ভাব হয়, এবার সেসব রোগ তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না।

আর্থিক খাতের আশু সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তার সরকার ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, রপ্তানিমুখী শিল্প, শ্রমিকদের সুরক্ষা, ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্পকে ওয়ার্কিং ক্যাপিট্যাল প্রদান, রপ্তানি বৃদ্ধিতে ঋণ প্রদান, কৃষি কৃষকদের সহায়তা, কর্মসৃজনের জন্য ঋণ প্রদান, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সুদ মওকুফ, পুনঃঅর্থায়ন স্কিম এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য বিমা চালুকরণ খাত প্রণোদনার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। পর্যন্ত আমরা মোট ১৩ দশমিক ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছি, যা আমাদের মোট জিডিপির দশমিক শূন্য শতাংশ।

সরকারপ্রধান বলেন, ‘কোভিড-১৯ বিস্তারের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষের জন্য আমরা তাত্ক্ষণিকভাবে খাদ্য অন্যান্য সহায়তার ব্যবস্থা নিয়েছি। এতে ১০ মিলিয়নের বেশি পরিবার উপকৃত হয়েছে। আমরা ৪০ লাখ শিক্ষার্থীকে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করেছি।তিনি বলেন, ‘করোনাকালে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুরসহ ৫০ লাখ মানুষকে নগদ অর্থসহায়তা দিয়েছি। সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে গ্রাম পর্যায়ের প্রায় ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে বিনা মূল্যে ৩০ ধরনের ওষুধ দেওয়া হয়।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত পৃথিবী বিনির্মাণে বৈশ্বিক আকাঙ্ক্ষার প্রতি আমাদের সমর্থন অবিচল। সেই বিবেচনা থেকে পরমাণু প্রযুক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের বিষয়ে উন্নয়নশীল দেশসমূহের কার্যক্রমকে আমরা জোর সমর্থন জানাই।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন এবং সেই সময়ে দেশে সংঘটিত গণহত্যা প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামে বাঙালি জাতি অবর্ণনীয় দুর্দশা, মানবতাবিরোধী অপরাধ গণহত্যার মতো জঘন্য অপরাধের শিকার হয়েছে। সেই কষ্টকর অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা নিপীড়িত ফিলিস্তিনি জনগণের ন্যায়সংগত দাবির প্রতি সমর্থন দিয়ে আসছি।

শেখ হাসিনা তার ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর এই সাধারণ পরিষদে দাঁড়িয়ে প্রথম ভাষণই বাংলায় প্রদানেরও স্মৃতিরোমন্থন করেন। তিনি বলেন, ‘আমি গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তিনি বলেন, ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে তার (বঙ্গবন্ধু) প্রদত্ত দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ বর্তমান সংকট মোকাবিলার জন্য আজো সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার এই দৃপ্ত ঘোষণা ছিল মূলত বহুপাক্ষিকতাবাদেরই বহিঃপ্রকাশ। বছর জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন এবং৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর তার (শেখ হাসিনা) ছোট বোন শেখ রেহানার প্রবাসে রিফিউজি জীবন কাটাতে বাধ্য হওয়ার মর্মন্তুদ ইতিহাসও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছি। দারিদ্র্য শোষণমুক্ত সেই সোনার বাংলাদেশ হবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত, যেখানে সবার মানবাধিকার নিশ্চিত হবে।শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে জাতি বিশ্বের কাছে এটিই আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার।