শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

রক্তাক্ত শ্রীলঙ্কা, শঙ্কিত বিশ্ব

আপডেট : ২৩ এপ্রিল ২০১৯, ০০:৫৯

নৃশংস ও বর্বর হামলায় রক্তাক্ত ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। রবিবার তিন গির্জা ও তিনটি অভিজাত হোটেলসহ আটটি স্থানে আত্মঘাতী হামলায় ২৯০ জন নিহত এবং ৫ শতাধিক আহত হয়েছেন। নিউজিল্যান্ডের মসজিদে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীর হামলায় ৫০ জন নিহত হওয়ার ৩৫ দিনের মাথায় খ্রিস্টানদের পবিত্র ইস্টার সানডেতে চালানো নারকীয় হামলায় বিশ্বজুড়ে শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। নিহতদের মধ্যে আছেন এক বাংলাদেশিসহ ৩৯ বিদেশি। ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এটাই সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী হামলা।

হামলার পর দুই দিনে ২৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আত্মঘাতী হামলায় জড়িত ছিল ৬ জন যাদের মধ্যে একজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। দুই দফায় কারফিউ ও জরুরি অবস্থা জারি করেছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে বলেছেন, হামলার তথ্য আগে পেলেও সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। হামলার দায়িত্ব কেউ স্বীকার না করলেও সরকার স্থানীয় জিহাদি সংগঠন ন্যাশনাল তাওহীদ জামাতকে দায়ী করছে। আর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ইসলামি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার করেছেন। পুরো বিশ্ব শ্রীলঙ্কার সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ করেছে। দেশটিতে আজ জাতীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে।

নারকীয় হত্যাযজ্ঞে শঙ্কিত বিশ্ব

খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা যখন ইস্টার সানডে পালন করছিল তখন বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। প্রথম হামলা হয় স্থানীয় সময় সকাল পৌনে ৯ টায়। তিনটি গির্জায় অন্তত ছয়টি বিস্ফোরণ হয়েছে। যে গির্জাগুলোতে বিস্ফোরণ হয়েছে সেগুলো কোচ্চিকাডে, নেগম্বো এবং বাট্টিকালোয়ায় অবস্থিত। নেগম্বোর সেইন্ট সেবাস্তিয়ান গির্জার ছাদও বিধ্বস্ত হয়েছে। এছাড়া রাজধানী কলম্বোতে অবস্থিত পাঁচ তারকা হোটেল সাংরি লা, কিংসবেরি এবং সিনামন গ্র্যান্ড হোটেলে বিস্ফোরণ হয়েছে। কিংসবেরি হোটেলের এক কর্মী জানিয়েছেন, সকালে নাস্তার জন্য আসা অতিথিরা যখন ফ্লোরে বসেছিলেন তখনই হামলা হয়। হোটেলের নীচে সর্বত্র রক্ত। চারটি হামলা প্রায় একই সময়ে সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে হয়। পরের দুটো হয় এর ২০ মিনিটের মধ্যে। পরে আরো একটি হোটেল ও বাড়িতে হামলা হয়। এসব বিস্ফোরণে বাংলাদেশসহ অন্তত ৯টি দেশের ৩৯ পর্যটক মিলে ২৯০ জন নিহত এবং ৫ শতাধিক আহত হয়েছেন। তবে কোথায় কতজন নিহত হয়েছেন সেই তথ্য পুলিশ প্রকাশ করেনি। গতকাল রাজধানীতে আরো বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। কলম্বোর বাস স্টেশন থেকে ৮৭টি বিস্ফোরক ডেটনেটর উদ্ধার করেছে নিরাপত্তা বাহিনী। এছাড়া একটি বাড়িতে অভিযান চালাতে গিয়ে বিস্ফোরণে তিন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও তাদের পরিচয় জানায়নি পুলিশ। তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সরকার। আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল একটি তদন্ত দল পাঠিয়েছে।

শ্রীলঙ্কার ফরেনসিক বিভাগের সিনিয়র কর্মকর্তা আরিয়ানন্দা ভেলিয়াংগা জানিয়েছেন, সাত আত্মঘাতী বোমারু গির্জা ও বিলাসবহুল হোটেলগুলোতে হামলায় অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে দুজন কলম্বোর সাগর তীরে হোটেল সাংরি লাতে গিয়ে নিজের উড়িয়ে দেয়। বাকি হামলাকারীরা আরো দুটি হোটেল ও তিনটি গির্জাকে টার্গেট করে। ভেলিয়াংগা জানান, আরো এক হোটেল ও কলম্বোর একটি বাড়িও তাদের টার্গেটে ছিলো। একটি চিড়িয়াখানায়ও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র ছয়জন আত্মঘাতী হামলাকারীর কথা জানিয়েছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গতকাল হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের বলেন, ‘খুবই ভয়ঙ্কর, খুবই ভয়ঙ্কর। এটা অচিন্ত্যনীয়’। তিনি শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের সঙ্গে ফোনালাপ করেছেন বলে জানিয়েছেন। ধর্মীয় উপাসনালয়ে একের পর হামলায় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র এবং সরকার প্রধানরা নিজেদের শঙ্কার কথা জানিয়ে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক দিয়েছেন।

নিরাপত্তায় ব্যর্থতার অভিযোগ

মন্ত্রিপরিষদের মুখপাত্র রাজিথা সেনারত্নে সম্ভাব্য হামলার বিষয়ে দুই সপ্তাহ আগেই সতর্কবার্তা পাওয়ার কথা নিশ্চিত করেছেন। ৪ এপ্রিল অর্থাত্ ঘটনার ১৪ দিন আগে তথ্য পাওয়া যায়। ওইদিন একটি বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা এক প্রতিবেদনে হামলার আশঙ্কার কথা জানায়। প্রতিবেদনে ক্যাথলিক ও খ্রিস্টানদের গির্জা, পর্যটন স্পট এবং অভিজাত হোটেলের কথা উল্লেখ ছিল। ৯ এপ্রিল পুলিশ প্রধানের কাছে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করা হয়। এতে জঙ্গি গোষ্ঠীর নামও উল্লেখ ছিল। এরপর পুলিশ প্রধান বিচার বিভাগ ও কূটনৈতিক শাখার নিরাপত্তা প্রধানদের কাছে হামলার আশংকার কথা জানিয়ে চিঠি পাঠান। কিন্তু এরপরও হামলা থামাতে ব্যর্থ হয় নিরাপত্তা বাহিনী। সেনারত্নে ব্যর্থতার জন্য প্রেসিডেন্ট সিরিসেনার সমালোচনা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেও বলেছেন, হামলার তথ্য আগে পেলেও যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। যদিও প্রতিরক্ষামন্ত্রী হেমাসারি ফার্নান্দো বলেছেন, চলতি মাসের শুরুতে পাওয়া সতর্কবার্তায় একটি বা দুটি সম্ভাব্য হামলার কথা বলা হলেও এতো বড় মাপের ঘটনার কথা কেউ ভাবতে পারেনি।

জরুরি অবস্থা ও কারফিউ

শ্রীলঙ্কার ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল সোমবার (গতকাল) মধ্যরাত থেকে জরুরি অবস্থা জারি করেছে। তারা এটিকে ‘শর্তযুক্ত জরুরি অবস্থা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। দেশটির প্রেসিডেন্টের মিডিয়া ইউনিটি থেকে দেয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এসব পদক্ষেপের লক্ষ্য সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ, মত প্রকাশের অধিকার খর্ব করা নয়। এছাড়া সোমবার রাত আটটা থেকে আজ মঙ্গলবার সকাল ৪টা পর্যন্ত কারফিউ বলবত্ থাকার ঘোষণা দেওয়া হয়। এর আগে রবিবার জারি করা কারফিউ প্রত্যাহার করা হয়েছিল। হোয়াটসঅ্যাপ এবং ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকে প্রবেশ করতে পারছেন না।

ইসলামপন্থী গোষ্ঠীর ওপর দায়

হামলার সাথে জড়িত আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ককে খুঁজে বের করতে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা আন্তর্জাতিক সহায়তা চাওয়ার পরপরই রাজিথা সেনারত্নে ইসলামপন্থী ন্যাশনাল তৌহিদ জামাতের (এনটিজে) নাম প্রকাশ করেছেন। তিনি এর আগে বলেছিলেন, দেশের ভেতরে থাকা একদল ব্যক্তি এসব হামলা করেছে এটা আমরা বিশ্বাস করি না। এখানে আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক আছে যাদের ছাড়া হামলা সফল হতো না। এদিকে কেলানিয়া, কিরিবাতগোদা ও জা এলায় পানি সরবরাহের সাথে বিষ মেশানোর যে খবর অনলাইনে ছড়িয়েছিল সেটিকে গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছে পুলিশ। রুশ বার্তা সংস্থা তাস জানিয়েছে, জামাত আল-তাওহিদ আল-ওয়াতানিয়া নামের একটি জঙ্গিগোষ্ঠী হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেছে। দুবাইভিত্তিক আল অ্যারাবিয়া টেলিভিশন চ্যানেলকে উদ্ধৃত করে এ কথা জানিয়াছে তাস। তবে এই জঙ্গি গোষ্ঠী সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানায়নি চ্যানেলটি।

শ্রীলঙ্কার কর্মকর্তারা বলছেন, এরা স্বল্প পরিচিত নতুন গোষ্ঠী যাদের সম্পর্কে কিছুদিন আগেও তেমন জানা ছিল না। কিছুদিন আগে একটি বুদ্ধ ভাস্কর্য ভাঙ্গার ঘটনার সঙ্গে এই গ্রুপটি জড়িত ছিল বলে ধারণা করা হয়। বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছড়ানোর অভিযোগে ২০১৬ সালে গোষ্ঠীটির একজন নেতাকে গ্রেফতারের পর প্রথম এটি আলোচনায় আসে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ন্যাশনাল তাওহীদ জামাত গ্রুপটি ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী ধ্যানধারণা লালন করে। শ্রীলঙ্কার স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম বলছে, এই গ্রুপটি কাট্টাকুডি নামের একটি মুসলিম অধ্যুষিত শহরে ২০১৪ সালে গঠিত হয়। তবে এর আগে মারাত্মক কোনো হামলার চালানোর সঙ্গে এদের নাম শোনা যায়নি। তবে দলটি তথাকথিত ইসলামিক স্টেট গ্রুপকে সমর্থন করতো বলে জানা যাচ্ছে। হামলার পর উল্লাস প্রকাশ করেছে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস।

জড়িতদের শাস্তি চান মুসলিম নেতারা

শ্রীলঙ্কার শীর্ষ মুসলিম নেতারা আত্মঘাতী বোমা হামলার সাথে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেছেন। মুসলিম তাত্ত্বিকদের কাউন্সিল ‘অল সেইলন জামিয়াতুল উলামা’ বলছে, সব ধর্মীয় স্থাপনাগুলোতে নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং ভয়াবহ ঘটনার সাথে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে আমরা সরকারকে অনুরোধ করছি। উল্লেখ্য, গত ১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডের দুটি মসজিদে এক শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীর বন্দুক হামলায় ৫০ জন নিহত হয়েছিলেন।

এক আত্মঘাতীর পরিচয়

সরকারের বিশ্লেষক এ. ওয়েলিঙ্গা সবগুলো হামলাই আত্মঘাতী বলে নিশ্চিত করেছেন। কলম্বোর একটি আদালতকে পুলিশ জানিয়েছে, সাংরি লা হোটেলে আত্মঘাতীর পরিচয় জানা গেছে। তার নাম ইসনান সিলাভান। তার সঙ্গে অন্য আত্মঘাতীর সম্পর্ক আছে বলে পুলিশ ধারণা করছে। তার একটি কারখানা আছে। ওই কারখানার ৯ কর্মীকে আটক করে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। -বিবিসি, রয়টার্স, সিএনএন, ডেইলি মেইল ও সিবিএস নিউজ