বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার অঙ্গীকার মোদির, রাহুলের অভিনন্দন ২৯ মে শপথ

আপডেট : ২৪ মে ২০১৯, ০১:১৪

নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দোর্দণ্ড দাপটে আবারো দিল্লির মসনদে বসছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ফের ভারতের ক্ষমতায় আসছে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ)। জয় নিশ্চিত হওয়ার পর দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার অঙ্গীকার করেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। অন্যদিকে ২০১৪ সালের মতো এবারো ভরাডুবি হয়েছে ভারতের সবচেয়ে পুরোনো রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের। খারাপ ফলের কারণে কংগ্রেসের সঙ্গে সঙ্গে বড় ধাক্কা খেয়েছেন দলটির সভাপতি রাহুল গান্ধীও। তবে পরাজয় মেনে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন তিনি। একইসঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর জোট সরকার গঠনের স্বপ্নও। বিপুল জয়ের পর প্রধানমন্ত্রী মোদিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন বাংলাদেশ, পাকিস্তান, চীনসহ বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানরা। আগামী ২৯ মে দ্বিতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নেবেন নরেন্দ্র মোদি।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারত। প্রায় ৯০ কোটি ভোটারের এই নির্বাচন ছিল এক বিশাল মহাযজ্ঞ। দীর্ঘ প্রায় আড়াই মাসের টানটান উত্তেজনা, উত্কণ্ঠা আর নাটকীয়তার পরিসমাপ্তি হলো বিজেপি জোটের বিপুল জয়ের মধ্য দিয়ে। বুথ ফেরত জরিপে বিজেপি জোটের জয়ের পূর্বাভাস ছিল; কিন্তু জনতার রায় সেই আভাসকেও ছাড়িয়ে গেছে। গতকাল সপ্তদশ লোকসভার নির্বাচনের ভোট গণনা শুরুর পর গোটা ভারত যেন গেরুয়া রঙে ছেয়ে যায়।

৫৪৩ আসনের লোকসভায় সরকার গড়তে কোনো দল বা জোটের প্রয়োজন ২৭২ আসন। তবে এখন পর্যন্ত একটি আসনে ভোটগ্রহণ বন্ধ রেখেছে নির্বাচন কমিশন। ৫৪২ আসনের ভোট গণনায় গতকাল রাত ১ টায় এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ২৫১ আসনে নিশ্চিত করেছে ক্ষমতাসীন বিজেপি। আরো ৫১ আসনে এগিয়ে ছিল দলটি। সেই হিসেবে এবারের নির্বাচনে ৩০২টি আসন পাচ্ছে বিজেপি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে তারা ২৮২টি আসন পেয়েছিল। এর মাধ্যমে ১৯৮৪ সালের পর লোকসভা নির্বাচনে পরপর দুইবার সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভের কৃতিত্ব দেখাল বিজেপি। অন্যদিকে ভারতের ইতিহাসে তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে টানা দুইবার সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করবেন মোদি।

এবারের নির্বাচনে বিজেপি নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) জোট ৫৪২ আসনের মধ্যে পাচ্ছে ৩৪৯টি আসন। ২০১৪ সালে এই জোট পেয়েছিল ৩৩৬টি আসন। নির্বাচনের আগে বিভিন্ন জরিপ বলছিলো এবার এনডিএ জোটের আসন কমবে। কিন্তু জনতার রায় তা উল্টে দিয়েছে। অন্যদিকে বিরোধীদল কংগ্রেস এককভাবে পাচ্ছে ৫২টি আসন। রাত ১টা পর্যন্ত ৩৯টি আসনে তারা জয় নিশ্চিত করেছে এবং ১৩টি আসনে তারা এগিয়ে রয়েছে। আর তাদের ইউপিএ জোট পাচ্ছে ৮১টি আসন। ২০১৪ সালে এই জোট পেয়েছিল ৬০টি আসন। বিজেপি এবং কংগ্রেসের বাইরে ভারতের অন্যান্য আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ১৮৮টি আসন পাচ্ছে। এসব দলের মধ্যে এনডিএ ও ইউপিএ জোটের শরিকরাও রয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গে, যেখানে রাজ্যের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস এতোদিন শক্ত অবস্থানে ছিল সেখানে অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছে বিজেপি। এই রাজ্যে এবার তারা ১৮টি আসন পেতে চলেছে। ২০১৪ সালে তারা পেয়েছিলো মাত্র দুইটি আসন। অন্যদিকে ২০১৪ সালে তৃণমূল পেয়েছিল ৩৪টি আসন। এবার সেখানে তারা পেতে চলেছে ২২টি আসন। কংগ্রেস পাচ্ছে দুইটি আসন। আর এবার একটি আসনও পাচ্ছে না বামরা। ভোটের ফল অনেকটা নিশ্চিত হওয়ার পর তৃণমূল নেত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এক টুইট বার্তায় বিজয়ীদের অভিনন্দন জানিয়েছেন।

ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তরপ্রদেশে ৮০টির মধ্যে ৬৩টি আসনে জয় পাচ্ছে বিজেপি জোট। আর সমাজবাদী পার্টি আর বহুজন সমাজ পার্টির মহাজোট পাচ্ছে ১৫টি আসন। এবারের নির্বাচনে এই মহাজোট বিজেপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল। ধারণা করা হচ্ছিলো, বিজেপির আসন ৩০ থেকে ৩৫ নেমে যাবে।

এই রাজ্যের বারানসি আসন থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চার লাখ ৮০ হাজার ভোটের ব্যবধানে দ্বিতীয়বারের মতো জয়ী হয়েছেন। গুজরাটের গান্ধীনগরে বড় ব্যবধানে জয় লাভ করেছেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ। এ জয়কে ভারতের জয় বলে মন্তব্য করেছেন অমিত শাহ। মোদি ও অমিত শাহ ছাড়াও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং-সহ কেন্দ্রীয় প্রায় সকল মন্ত্রী জয়ী হচ্ছেন। গান্ধীর হত্যাকারীকে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যকারী সাধ্বী প্রজ্ঞা ঠাকুরও মধ্য প্রদেশের একটি আসন থেকে জয়ী হয়েছেন।  

তবে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী উত্তর প্রদেশের আমেথি আসনে বিজেপি নেত্রী স্মৃতি ইরানির কাছে পরাজিত হয়েছেন। ২০০৪ সাল থেকে পরপর তিনবার এই আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। তবে কেরালার ওয়েনাদ আসনে চার লাখ ৩১ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন রাহুল গান্ধী। রায় বরেলি আসনে জয় পেয়েছেন কংগ্রেসের নেত্রী সোনিয়া গান্ধী।

এই নির্বাচনে গতবারের মতো গুজরাটের ২৬ আসনেই জয় পেতে চলেছে বিজেপি। রাজস্থানের ২৫টি আসনেই জয় পাচ্ছে তারা। এছাড়া হিমাচলের চার ও উত্তরখন্ডের পাঁচ আসনেই জয় পাচ্ছে বিজেপি। মধ্য প্রদেশের ২৯ আসনের মধ্যে ২৮টি, ছত্তিশগড়ের ১১টির মধ্যে ৯টি, বিহারের ৪০টির মধ্যে ৩৮টি, ঝাড়খন্ডের ১৪টির মধ্যে ১০টি, হরিয়ানার ১০টির মধ্যে ৯টি, কর্নাটকের ২৬টির মধ্যে ২৩টি, মহারাষ্ট্রের ৪৮টির মধ্যে ৪১টি, পশ্চিমবঙ্গে ৪২টির মধ্যে ১৯টি, ওড়িশায় ২১টির মধ্যে ৬টি এবং দিল্লির সাতটি আসনেই জয় পেতে চলেছে বিজেপি। উত্তরপ্রদেশের সামান্য ক্ষতি বিজেপি পুষিয়ে নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশা থেকে। বিজেপির কৌশল প্রণয়নকারীরা নিজেদের শক্তিবৃদ্ধির জন্য দীর্ঘদিন ধরেই পাখির চোখ করে রেখেছিলেন পূর্ব ভারতকে। এবারের নির্বাচনে তার সুফল পেয়েছে।

অন্যদিকে ১৭ রাজ্য এবং কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে কোনো আসনই পায়নি কংগ্রেস। তবে পাঞ্জাবে ভালো করেছে কংগ্রেস। ওই রাজ্যে ১৩ আসনের মধ্যে ৮টিতেই জয়ী হতে চলেছে তারা। তামিল নাড়ুতে ডিএমকের সঙ্গে জোট করেছে কংগ্রেস। এই জোট ৩৯টি আসনের মধ্যে ৩৫টিতেই এগিয়ে রয়েছে। জম্মু ও কাশ্মিরে সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আব্দুল্লাহ জয়ী হতে চলেছেন, তবে নির্বাচনে হেরেছেন সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি।

এবারের নির্বাচনে ৬৭ শতাংশ ভোট পড়েছে। নিরঙ্কুশ জয় নিশ্চিত হবার পর এক টুইট বার্তায় মোদি বলেন, এ জয় ভারতের। একসঙ্গেই এগিয়ে যাব। একসঙ্গেই উন্নতি করবো। একসঙ্গেই শক্তিশালী ভারত গড়ব। রাতে দিল্লিতে বিজেপির সদর দপ্তরে দেওয়া বিজয় ভাষণে মোদি বলেন, দেশবাসী আমাকে বিরাট দায়িত্ব দিয়েছেন। এখন থেকে আমার সময় শুধুই দেশবাসীর জন্য। আপনারা এই ভিখারির ঝুলি ভর্তি করে দিয়েছেন, আপনাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে আমি সব সময় থাকবো। গণতন্ত্র, সংবিধানের মর্যাদা রক্ষা করব। তিনি বলেন, আমি আশ্বস্ত করছি, সবার সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে আমরা কাজ করব।

অন্যদিকে পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর গতকাল এক সাংবাদিক সম্মেলনে রাহুল গান্ধী বলেন, মানুষ প্রধানমন্ত্রী পদে নরেন্দ্র মোদিকে চেয়েছেন। মানতেই হবে, বিজেপি ও মোদি দারুণ জয় পেয়েছেন। সারা দেশের মানুষকে আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমাদের লড়াই অব্যাহত থাকবে। আমরা কংগ্রেসের আদর্শ নিয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়ে যাব।

মোদির জয়ে ভারতের পুঁজিবাজার গতকাল চাঙ্গা হয়ে ওঠে। ভারতের শেয়ার বাজার সব রেকর্ড ভেঙে ৪০ হাজার পয়েন্ট ছাড়িয়ে যায়। বিনিয়োগকারীদের আশা, অর্থনৈতিক সংস্কারে মোদি সরকার আরো পদক্ষেপ নেবে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হবে কোটি কোটি ভারতীয় বেকারের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। এছাড়া কৃষকদের আয় বৃদ্ধি ও ব্যাংকিং খাতকে পুনর্জীবিত করা। আর প্রধানমন্ত্রী মোদি দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিলেও এটা সহজ হবে না। কারণ বিজেপির প্রচারণা সব সময় বিভক্তিমূলক। যে কারণে ভারতের মুসলিমরা আশঙ্কা প্রকাশ করছে যে, তাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করা হতে পারে।

মোদি জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে আরো কঠোর পদক্ষেপ নেবেন এমনটাই চাইছেন বিজেপি সমর্থকরা। একইসঙ্গে রাম মন্দির নির্মাণে পদক্ষেপ চায় তারা।

গতকাল ভোট গণনা শুরুর পর থেকেই বিজেপির কর্মী-সমর্থকরা উত্সব শুরু করে। বিজেপির মুখপাত্র নলিন এস কোহলি বলেন, এটি হলো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সত্ ও দৃঢ় নেতৃত্বের প্রতি জনতার রায়। অন্যদিকে দুর্বল অর্থনীতি সত্ত্বেও বিজেপিকে কেন জনগণ বেছে নিল- এমন প্রশ্নের জবাবে কংগ্রেসের মুখপাত্র সালমান সোজ বলেন, জনগণ বিজেপিকে দ্বিতীয় সুযোগ দিয়েছে। আমি আশা করি, তারা এই সুযোগকে কাজে লাগাবেন।