শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

স্থবির সংস্কৃতি অঙ্গন

আপডেট : ১৮ আগস্ট ২০১৯, ২১:৪৭

সংস্কৃতির শহর হিসেবে গড়ে উঠতে থাকা রাজধানী ঢাকায় যেন হঠাত্ করেই নেমে এসেছে স্থবিরতা। জাতীয় শোক দিবস সামনে রেখে সরকারি কয়েকটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছাড়া সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কার্যক্রম নেই বললেই চলে। চাকরি, ব্যবসা, যানজট যখন কংক্রিটের নগরীতে জীবনকে যান্ত্রিক করে তোলে, তখন এসব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড মরুভূমির বুকে সবুজ উদ্যানের মতো হাজির হয় মানুষের সামনে। সে তুলনায় বর্তমান সময়ে রাজধানীর সংস্কৃতি অঙ্গন পুরোপুরি ঝিমিয়ে পড়েছে।

এমনিতেই বিশ্বায়নের তোড়ে সারা বিশ্বেই জাতীয় সংস্কৃতি টিকে থাকার সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বাঙালি সংস্কৃতিও তার স্বকীয়তা টিকিয়ে রাখতে বেসামাল হয়ে পড়েছে। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা বলছেন, এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার যে ধারা, তা পুরোপুরি পালটে ফেলে স্কুল-কলেজ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সম্পৃক্ত করে সামগ্রিক সাংস্কৃতিক জাগরণ সৃষ্টির আহ্বান জানান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা। তারা বলেন, এখন এমন অনুষ্ঠানের চল শুরু হয়েছে, যা সেই অনুষ্ঠানে না গিয়েও দর্শকরা বলে দিতে পারে কী হবে সেখানে। মানুষের মধ্যে সেই আগ্রহ সেই চমকটাও সৃষ্টি করতে পারছেন না সংস্কৃতিকর্মীরা। সাংস্কৃতিক জোট, নাট্য ফেডারেশনের মতো সংগঠনগুলোও বছরের পর বছর ধরে রুটিন ওয়ার্কের মতো একই ধারায় একই নাটক পরিবেশন করছে, তাই মানুষ আর এসব গ্রহণ করছে না।

রাজধানীর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডগুলো কিছু নির্দিষ্ট এলাকাকে কেন্দ্র করে হতে দেখা যায়। শহীদ মিনার, টিএসসি, শাহবাগ, শিল্পকলা একাডেমি আর মহিলা সমিতি ছাড়া রাজধানীর আর  কোথাও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কোনো উদ্যোগ নজরেই পড়ে না। উত্তরার মতো মিরপুর, খিলগাঁও-বাসাবো, যাত্রাবাড়ী—বিশাল জনগোষ্ঠীর বাস এসব এলাকায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার কোনো স্থানই নেই।

সরকারের মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজস্ব ভবন ও মিলনায়তন নিয়ে নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে দেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান ছায়ানট। এর বাইরে বেসরকারি পর্যায়ে আর কোনো সংগঠন এই উদ্যোগ নেয়নি। সবাই সরকারি ও ভাড়া করা মঞ্চের ওপর নির্ভরশীল।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব জানান, সংস্কৃতিকর্মীরা দলকেন্দ্রিক আয়োজনের বাইরে টিভিসহ নানা ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রমের দিকে বেশি আগ্রহী। যারা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে দিকপাল, তারাও টিভি নাটকে অভিনয়, বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণ ও ব্যবসা নিয়ে এত বেশি ব্যস্ত যে, যেই মঞ্চ থেকে তাদের উত্থান, সেই ক্ষেত্রটি সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়েছেন। ফলে ঈদে ও ঈদের পরে সবাইকে টিভির স্ক্রিনে যতটা নজরে পড়ে, ততটা মঞ্চে দেখা যায় না।

এ প্রসঙ্গে ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি ডা. সারওয়ার আলী ইত্তেফাককে বলেন, বিশ্বায়নের অভিঘাতে জাতীয় সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখাটা কঠিন হয়ে পড়ছে। বাঙালি সংস্কৃতি বর্তমানে ত্রিমুখী আক্রমণের মুখে রয়েছে। প্রথমটি মৌলবাদ। এ কারণে অনেকেই সংস্কৃতিচর্চা থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব এবং তৃতীয়ত আমাদের তরুণদের পাশ্চাত্য সংগীতের প্রতি অন্ধ অনুকরণ। এসবের কারণে বাঙালির আদি সংস্কৃতির চর্চা ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, ‘এই ত্রিমুখী আক্রমণ কাটিয়ে প্রায় সব এলাকাতেই সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে উঠতে দেখা যায়। কিন্তু তারাও এই আগ্রাসনের বাইরে নয়। এই সবকিছুর পরেও আমি আশাবাদী। পহেলা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসকে ঘিরে বাঙালির একধরনের সাংস্কৃতিক জাগরণ দেখতে পাই। এটা আশা জাগায়।’

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি প্রাবন্ধিক মফিদুল হক বলেন, ‘হলি আর্টিজানে হামলার পর আমাদের উচিত ছিল সাংস্কৃতিক জাগরণ সৃষ্টি করা। সেই লক্ষ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজভিত্তিক সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ছড়িয়ে দেওয়া। আর সাংস্কৃতিক মহড়া, অনুষ্ঠান আয়োজনও এসব স্কুল-ভবনকে কেন্দ্র করে পরিচালনা করা। এতে আমরা বহু মানুষকে সম্পৃক্ত করতে পারব। যা-ই করি না কেন, রুটিন ওয়ার্কের বাইরে গিয়ে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে সব আয়োজন।’ ঈদের পরে শিল্পকলায় দু-একটি নাটক প্রদর্শনী ছাড়া আর কোনো আয়োজন নেই। আর জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষ্যে রাজনৈতিক সহযোগী সংগঠনগুলোর আলোকচিত্র প্রদর্শনী এবং শিল্পকলা একাডেমি ও জাতীয় জাদুঘরে চিত্র প্রদর্শনী ও সেমিনার ছাড়া অন্য কোনো আয়োজন চোখে পড়েনি। এমনকি দেশের অসংখ্য সাংস্কৃতিক সংগঠনেরও কোনো আয়োজন চোখে পড়ছে না। শহীদ মিনার, টিএসসি, মহিলা সমিতি, শাহবাগ চত্বর, ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবরের উন্মুক্ত মঞ্চ, পাবলিক লাইব্রেরির মঞ্চগুলো ফাঁকা পড়ে আছে।

তবে এটাও সত্যি, অসংখ্য সাংস্কৃতিক সংগঠন থাকলেও তাদের অনুষ্ঠান করার জায়গা শিল্পকলা, টিএসসি নয়তো পাবলিক লাইব্রেরির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এখানকার দর্শকও নির্দিষ্ট। কিন্তু রাজধানীর ব্যাপ্তি অনেক। অনেক মানুষের বাস। এসব মানুষের পৌঁছানোর মতো অবকাঠামোগত সুবিধা নেই।

এর পরিপ্রেক্ষিতে পুরো রাজধানীতে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলার কথা বলছেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা। দেখা যায়, সাংস্কৃতিক অবকাঠামো না থাকার কারণে রাজধানীর মানুষের একমাত্র বিনোদনের জায়গা হয়ে উঠেছে রেস্টুরেন্টগুলো। পরিবার নিয়ে খাওয়া-দাওয়া ছাড়া বিনোদানের কোনো ক্ষেত্র নেই।

এ প্রসঙ্গে মফিদুল হক বলেন, ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবরটাকে রেস্টুরেন্ট আর খাবারের দোকানগুলো গিলে ফেলেছে। অথচ এটাকে খুব সুন্দর সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে রূপান্তর করা যেত। তিনি বলেন, এলাকার স্কুল-কলেজ, ক্লাব-সংগঠনকে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি আগ্রহী করে তোলার সামগ্রিক উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। তা না হলে উত্সবের আয়োজন বড়ো অনুষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ থাকবে, বড়ো সাংস্কৃতিক অভিঘাত সৃষ্টি করবে না।

এ প্রসঙ্গে গোলাম কুদ্দুছ বলেন, ঢাকায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার আরো অনেক স্থান প্রয়োজন। অবকাঠামোগত সুবিধা না থাকলে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। মিরপুরে ৫০ লাখ মানুষের বাস, কিন্তু একটিও মিলনায়তন সেখানে নেই। অন্ততপক্ষে ২০টি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র বা মিলনায়তন প্রয়োজন। তরুণরা বিপথগামী হবেই। এক্ষেত্রে কমিউনিটি সেন্টারগুলো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড হিসেবে ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া এবং সেই সঙ্গে আলাদাভাবে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলা প্রয়োজন।