শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

সচেতনতার দ্বিগুণ থাকতে হবে মশা নিধনের কর্মসূচি

আপডেট : ১৮ আগস্ট ২০১৯, ২১:৫০

সচেতনতার দ্বিগুণ থাকতে হবে এডিস মশা নিধনের কর্মসূচি। তাহলেই ডেঙ্গুর প্রকোপ কমবে বলে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা জানিয়েছেন। প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ জানান, এডিস মশার প্রজনন ধ্বংস না হলে ডেঙ্গুর প্রকোপ থামবে না। মাঠ পর্যায়ে মশা নিধন কার্যক্রম কতটা সফল হচ্ছে সেটা নিয়মিত সার্ভে করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। বাংলাদেশ সফররত সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ডা. মো. তৌফিক ইসলাম বলেন, সুস্থ হওয়ার পরেও একজন রোগী ১০-১৫ দিন ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করে। তাই এই সময়টা আবারো এডিসের কামড় হতে পারে আরো ভয়ঙ্কর। বিপদ ডেকে আনতে পারে আশপাশের মানুষের। তাই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়া রোগীদের বেশি সতর্ক থাকতে হবে।

চলতি বছর দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি ছাড়িয়েছে সব রেকর্ড। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত সারাদেশের হাসপাতালগুলোতে সর্বমোট ডেঙ্গু আক্রান্ত ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৫৩ হাজার ১৮২ জন। এর মধ্যে চিকিত্সা শেষে ছাড়পত্র নিয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ৪৫ হাজার ৯৭৪ জন। বর্তমানে চিকিত্সাধীন আছেন ৭ হাজার ১৬৮ জন রোগী। ঈদের পর তিন দিন ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা কমতে থাকলেও তা আবারও বেড়েছে। গতকাল রবিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় এক হাজার ৭০৬ জন মানুষ ডেঙ্গু নিয়ে সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশনস অ্যান্ড কন্ট্রোল রুম জানিয়েছে। এর আগে শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ১ হাজার ৪৬০ জন ডেঙ্গু নিয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তার আগের ২৪ ঘণ্টায় এই সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৭২১ জন। এদিকে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গতকাল আরো দুই মারা গেছেন।

মহেশপুরে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রী মারা গেছেন। উপজেলার জলিলপুর ঘাটকুলপাড়ার আব্দুস সেলিমের মেয়ে মামনী খাতুন (২০) ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে শনিবার তাকে প্রথমে মহেশপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাকে যশোর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হলে  চিকিসাধীন অবস্থায় গতকাল সকালে তার মৃত্যু হয়। ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে লেখাপড়া করতেন তিনি। অপরদিকে সিরাজগঞ্জের কামারখন্দে ডেঙ্গুতে মেহেদী হাসান মীম তালুকদার (১৬) নামে এক কলেজছাত্র মারা গেছেন।  মেহেদী হাসান মীম জেলার কামারখন্দ উপজেলার হালুয়াকান্দি গ্রামের আমিনুল ইসলাম মন্নু তালুকদারের ছেলে ও সরকারি হাজী কোরপ আলী ডিগ্রি কলেজের একাদশ প্রথম বর্ষের ছাত্র।

অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, এডিস মশার ব্যাপারে জনগণ যতটা সচেতন, সিটি করপোরেশন ততটা সচেতন নয়। এ কারণে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। মশা নিধনের কর্মসূচি ভালোভাবে না চালালে আমরা যতই স্লোগান বা বাহাবা দেই না কেন কাজের কাজ কিছুই হবে না। মশা নিধন না হলে সার্বিক ফলাফল হবে শূন্য।

এদিকে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ডা. মো. তৌফিক ইসলাম কিভাবে ডেঙ্গুতে সাফল্য পেয়েছে দেশটি তা তুলে ধরে বলেন, ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতা আর কমিউনিটি লেভেলের কার্যক্রমই মূল চাবিকাঠি। তিনি আরো বলেন, ওখানে প্রতিটি নাগরিকের ঘরে ঘরে ডেঙ্গু প্রতিরোধে লিফলেট দেওয়া হয়। এছাড়া সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে যে বাসায় যেনো মশার লার্ভা জন্ম না নেয়। সেখানে সপ্তাহে এবং মাসে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ভিজিট করে, তারা যদি লার্ভা পায় তাহলে জরিমানা হয়।

তিনি বলেন, ডেঙ্গু মোকাবিলায় দক্ষতা দেখিয়েছেন এদেশের চিকিত্সকরা। তবে হাসপাতাল থেকে ফিরেও ১০-১৫ দিন ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করে একজন রোগী। তাই ঐ সময়টাতেও থাকতে হবে সাবধানতায়। এ বিষয়ে কাউন্সেলিংয়ের পরামর্শ দেন এই বিশেষজ্ঞ।

এসব পরামর্শ আমলে নিয়ে নতুন পরিকল্পনার কথা জানালেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, মানুষকে তার নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে হবে। হাসপাতাল থেকে মুক্ত হওয়ার পরেও ভুললে চলবে না যে আমার কারণে অপরজন আক্রান্ত হতে পারে। কাজেই এই ধরনের পরমার্শ আরো দেয়ার ব্যবস্থা আমরা করবো। ডেঙ্গু পরিস্থিতি তাড়াতাড়ি নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে আশাবাদী তিনি।

সরেজমিন ঢাকা সিটির বিভিন্ন ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, সিটি করেপারেশন যা বলছে, মাঠ পর্যায়ে তার প্রতিফলন নেই বললেই চলে। মাঠ পর্যায়ে মশা নিধন কার্যক্রম একেবারেই দুর্বল। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঢাকঢোল পিটিয়ে শুধু সচেতনতা সৃষ্টি করলে হবে না, মশা নিধন কার্যক্রম জোড়ালোভাবে চালাতে হবে। কারণ মশা না কামড়ালে ডেঙ্গু হবে না। বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, এখন প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। একটানা ৭/৮ দিন বৃষ্টি না হলে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরো বাড়বে। তাই মশা মারার কোন বিকল্প নেই। এদিকে দেশের চিকিত্সক-নার্সরা ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের নজিরবিহীন সেবা প্রদান করছেন। এমনিতেই চিকিত্সক-নার্স সংকট, তার ওপর ডেঙ্গুর রোগীর বাড়তি চাপ ভালভাবে সামাল দিচ্ছেন তারা। এটা বিশ্বের যেকোন দেশকে হার মানাবে।

সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক সানিয়া তহমিনা বলেন, জুন-জুলাই-আগস্ট এই তিন মাস ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি। অক্টোবরে কমে যায়। তিনি বলেন, ডেঙ্গু থেকে রেহাই পেতে মশা নিধন কার্যক্রম চালাতে হবে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, গত ১০ আগস্ট থেকে মশা মারার নতুন ওষুধ দেওয়া শুরু হয়েছে। সচেতনতা বৃদ্ধি এবং মশা নিধন এই দুটো সমন্বিত করেই সিটি করপোরেশন কাজ করছে। দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মশা নিধন কর্মী ৬০ ওয়ার্ডে ও ১০০ স্কোয়ার্ড দলও মাঠে কাজ করছে।

আওয়ামী লীগের ডেঙ্গু প্রতিরোধ মনিটরিং সেলের সাথে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বৈঠক

‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও চিকিত্সা মনিটরিং সেল’ ডেঙ্গু প্রতিরোধে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণে করণীয় বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক এমপির সাথে মতবিনিময় করেছেন। গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দপ্তরে অনুষ্ঠিত এই সভায় ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয় ও জনসচেতনতা সৃষ্টিতে প্রচারণা বিষয়ে আলোচনা করা হয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এমপি’র সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় অন্যান্যের মধ্যে আওয়ামী লীগ ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও চিকিত্সা মনিটরিং সেলের আহ্বায়ক ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক ডা. রোকেয়া সুলতানা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)’র উপাচার্য ও কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া, স্বাচিপ মহাসচিব ডা. এম এ আজিজ, বিপিএসপিএ’র মহাসচিব ডা. জামাল উদ্দিন চৌধুরী, কমিটির সদস্য ডা. এহসানুল কবীর জগলুল, ডা. রউফ সরদার, ডা. কামরুল হাসান মিলন, ডা. পুরবী রাণী দেবনাথ, ডা. আবু ইউসুফ ফকির, ডা. মো. জাবেদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।