শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

খালেদ শামীম ফিরোজের উত্থান যেভাবে

আপডেট : ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ২২:০৭

খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, জি কে শামীম ও মোহাম্মদ শফিকুল আলম ফিরোজ-এই তিন জনই টেন্ডারবাজি করতেন। তাদের অবৈধ টাকার ভাগ পেতেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। কিন্তু গ্রেফতার হওয়ার তাদের পাশে কেউই নেই। সুবিধাভোগীরা চোখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।

খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া : ফ্রিডম পার্টির ক্যাডার

থেকে আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন

অস্ত্রসহ গ্রেফতার ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পা-দক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ওরফে ল্যাংড়া খালেদ ছিলেন ফ্রিডম পার্টির নেতা।  সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকারী খন্দকার আব্দুর রশিদ, সাঈদ ফারুক রহমান ও বজলুল হুদা ৮০-এর দশকে গঠন করেন বাংলাদেশ ফ্রিডম পার্টি। ১৯৮৭ সালে ফ্রিডম পার্টির ক্যাডার মানিক ও মুরাদের হাত ধরেই খালেদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু।  ১৯৮৯ সালে ফ্রিডম পার্টির ক্যাডাররা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে হামলা করে। এতে খালেদ ও যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত রিপণ অংশগ্রহণ করেছিল। এ হামলায় অভিযুক্তের প্রাথমিক তালিকায় খালেদের নাম থাকলেও ঠিকানা উল্লেখ না থাকায় বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা পরবর্তীতে মোটা অংকের টাকায় তার নাম বাদ দেয়। ১৯৯১ সালে মানিক ও মুরাদের নেতৃত্বে খালেদ জামায়াত নেতা আব্বাস আলী খানের নির্বাচন করেছিল। নির্বাচনীর কাজের জন্য সে সময় তাদেরকে জামায়াতের পক্ষ থেকে ওয়াকিটকিও দেওয়া হয়েছিল। এক সময় শান্তিনগরের হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজে ভর্তি হন তিনি। সেখানে তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে পুলিশের সঙ্গে তার সংঘর্ষ বাঁধে। পুলিশের গুলিতে তার একটি পা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই থেকেই তাকে ল্যাংড়া খালেদ নামে অনেকে চেনে। পরবর্তীতে বিএনপির এক শীর্ষ নেতার ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হন খালেদ। তার মায়ের নামও খালেদা- এমন কথা বলে সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করতেন। তবে ফ্রিডম পার্টির সঙ্গে বিএনপির অলিখিত সমঝোতা থাকার কারণে তিনি বিএনপি বা এর কোনো অঙ্গ সংগঠনে যুক্ত হওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। ১৯৯৪ সালের মেয়র নির্বাচনে খালেদ খিলগাঁও রেলওয়ে কলোনী থেকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে আসা আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ ও তার কর্মীদের অস্ত্রের মুখে বের করে দেন। খালেদ মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমের অনুমতি পান। এছাড়া যুবদলের সন্ত্রাসী মজনুর সকল রাজনৈতিক কার্যক্রমের ব্যয় বহন করতেন খালেদ।

২০১০ সালে খালেদ যুবলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। এ পরিচয়ে খিলগাঁও বাজার কমিটির সভাপতি হন। যুবলীগে প্রথমে তাকে শাহজাহানপুর থানা শাখার সভাপতি পদ দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তিনি মহানগরের সাংগঠনিক পদ দাবি করেন। শোনা যায়, এ পদ লাভে পলাতক এক শীর্ষ সন্ত্রাসীর সুপারিশ ছিল। ২০১৩ সালে মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের কমিটি ঘোষণার সময় খালেদ মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদ পান। অন্যদিকে একের পর এক মামলা থেকে রেহাই পাওয়া শুরু করেন।

ভারতে পলাতক বিএনপিপন্থী পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহমেদ মানিকের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে কাজ করার পর যুবলীগের পদ পেয়ে খিলগাঁও ও শাহজাহানপুরে মানিকের স্থলাভিষিক্ত হন। সেই সম্পর্কে ভাঙন ধরার পর তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে দুবাইয়ে পলাতক আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সঙ্গে। তার সহযোগিতা নিয়ে টেন্ডারবাজিতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেন খালেদ। সেই টাকার ভাগ নিয়মিত পৌঁছে যেত জিসানের কাছে। ‘আন্ডারওয়ার্ল্ডে’ খালেদের অবস্থান প্রমাণে সিঙ্গাপুরের অভিজাত হোটেল মেরিনা বে’র সুইমিংপুলে জিসান ও খালেদের সাঁতার কাটার ছবি দিয়ে ছাপানো পোস্টারে ছেয়ে যায় নগরী। যুবলীগের এক নেতাকে সরিয়ে দিতে একে-২২ রাইফেলসহ ভারী আগ্নেয়াস্ত্রও এনেছিলেন খালেদ। এসব অস্ত্র পরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ উদ্ধার করে। জিসানের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হলেও আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী নবী উল্লাহ নবীর সঙ্গেও রয়েছে খালেদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। গত সপ্তাহে দু’জনের মধ্যে বৈঠকও হয়েছে।

অস্ত্রধারী ছয় দেহরক্ষী নিয়ে টেন্ডারবাজিতে যেতেন শামীম

শুক্রবার রাজধানীর নিকেতনে ব্যবসায়িক কার্যালয় জি কে বিল্ডার্সে অভিযান চালিয়ে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকার বেশি নগদ অর্থ, ১৬৫ কোটি টাকার বেশি এফডিআর এবং বিপুল মার্কিন ও সিঙ্গাপুরি ডলারসহ আটক করা হয় যুবলীগ নেতা নামধারী জি কে শামীমকে। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার সন্মানদী ইউনিয়নের (চরভুলুয়া গ্রামের) দক্ষিণপাড়ার মৃত মো. আফসার উদ্দিন মাস্টারের ছেলে জি কে শামীম। আফসার উদ্দিন মাস্টার ছিলেন হরিহরদি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তার তিন ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে শামীম মেজ। বড় ছেলে গোলাম হাবিব নাসিম ঢাকায় জাতীয় পার্টির (জাপা) রাজনীতি করেন। স্থানীয় ও তার কর্মীরা জানান, প্রাইমারি ও হাই স্কুল পাস করার পর ঢাকার বাসাবো আর সবুজবাগ এলাকায় বড় হয়েছেন তারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইরেজিতে অনার্স, মাস্টার্স করেন। বিবাহিত জীবনে তিনি দুই কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক। স্ত্রী শামীম সুলতানা ঢাকার একটি সরকারি কলেজের প্রভাষক। দুই মেয়ে ও ছেলে ঢাকায় লেখাপড়া করে বলে তার এক আত্মীয় নিশ্চিত করেছেন। গ্রামে খুব একটা যাতায়াত নেই। শামীম যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সমবায় বিষয়ক সম্পাদক বলে দাবি করতেন। যদিও কেন্দ্রীয় যুবলীগ ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, শামীম যুবলীগের কোনো পদে নেই। পারিবারিক সূত্রে তিনি বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত।

বিএনপি-জামায়াতের সময় শামীম ছিলেন ঢাকা মহানগর যুবদলের সহ-সম্পাদক এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতার খুবই ঘনিষ্ঠ। ওই নেতার সুনজরের কারণে তিনি গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ঠিকাদারি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। জি কে শামীমের ভয়ে মতিঝিল, পল্টন, শান্তিনগরের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পালিয়ে বেড়িয়েছেন। রাজধানীর সবুজবাগ, বাসাবো, মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকায় জি কে শামীম প্রভাবশালী ঠিকাদার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। পরবর্তীতে ২০০১ সালে গণপূর্ত ভবনের সব টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেন। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীনই সে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন। বিএনপি ক্ষমতাচ্যুত হলে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আধিপত্য ধরে রাখতে ভোল পাল্টিয়ে যুবলীগ নেতা পরিচয় দিতে থাকেন। তার নিয়ন্ত্রণে চলে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সকল প্রকার সরকারি টেন্ডার। ছয়জন অস্ত্রধারী দেহরক্ষী নিয়ে চলাফেরা করতেন তিনি।

ধানমন্ডি পান্থপথ এলাকায়  কেউ বাড়ি তুললেই একটি ফ্ল্যাট পেতেন ফিরোজ

ধানমন্ডির কলাবাগান ক্লাবের ক্যাসিনো নিয়ন্ত্রণ করতেন ক্লাবটির সভাপতি ও কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা শফিকুল আলম ফিরোজ। কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও বায়রার সিনিয়র সহ-সভাপতি ফিরোজ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চাঁদপুর-৫ (শাহরাস্তি-হাজীগঞ্জ) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। ফিরোজ কলাবাগানে ৩০ কাঠার জায়গা দখলে নিয়েছেন। ৭/৮ বছর ধরে পান্থপথ, কলাবাগান ও রাজাবাজারের কিছু অংশ, মিরপুর রোডের পূর্ব অংশে যারা বাড়ি করবে তাদের নগদ টাকা ও একটি করে ফ্ল্যাট দিতে হতো ফিরোজকে। পান্থপথের একটি বেসরকারি হাসপাতাল নির্মাণ কাজ দুই বছর বন্ধ রাখে ফিরোজ। পরে বোঝাপড়া হওয়ার পর নির্মাণ কাজ চালু হয়। ফিরোজের সঙ্গে আপোষ করতে হয়েছে।