শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব আগেও প্রত্যাখ্যান করেছি :মেনন

আপডেট : ২০ অক্টোবর ২০১৯, ২২:২৮

 ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি গত নির্বাচনে দেশের মানুষ ভোট দিতে পারেনি’—বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি সভাপতি রাশেদ খান মেননের এই বক্তব্য গতকাল রবিবার দিনভর রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সারাদেশে ছিল আলোচনার মুখ্য বিষয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এনিয়ে ছিল তক্কাতক্কির ঝড়। এর মধ্যে গতকাল বিকালে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে আগের দিনের অবস্থান থেকে সরে মেনন বললেন, ‘আমার বক্তব্য সম্পূর্ণ উপস্থাপন না করে অংশ বিশেষ উত্থাপন করায় এই বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। একাদশ সংসদের সফল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু অভিজ্ঞতাটি সুখকর নয়।’ তবে ‘আমার বক্তব্য সম্পর্কে গণমাধ্যম ভুল বার্তা দিয়েছে’—মেনন এই দাবি করলেও তারা বক্তব্যের ভিডিও ইউটিউব ও ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এখনো রয়েছে।                ‘মানুষ ভোট দিতে পারেনি’—মেননের এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় গতকাল সকালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘মন্ত্রী হলে মেনন কি একথা বলতে পারতেন?’ ওবায়দুল কাদেরের এই মন্তব্য সম্পর্কে মেনন সন্ধ্যায় ইত্তেফাককে বলেন, ‘তার এই মন্তব্য দুঃখজনক। এটা সঠিক নয়। কারণ অতীতে সংকটময় সময়েও আমি মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছি।’ প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত মহাজোট সরকারের চার বছরের মাথায় মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব পেলেও তাতে সাড়া দেননি মেনন।

মেননের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে ওবায়দুল কাদের এটাও বলেছেন, ‘মেনন ১৪ দলের অন্যতম একজন শীর্ষ নেতা। ১৪ দলের সমন্বয়ক আমাদের নাসিম সাহেব (মোহাম্মদ নাসিম)। মেননের বক্তব্যের বিষয়ে আমরা নাসিম সাহেবের কাছ থেকে জানতে চাইব।’ পরে এ ব্যাপারে ১৪ দলের সমন্বয়ক ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘রাশেদ খান মেননের বক্তব্য দুঃখজনক। ১৪ দলের বৈঠক ডেকে এ ব্যাপারে তার কাছ থেকে জানতে চাওয়া হবে।’

ওবায়দুল কাদের ও মোহাম্মদ নাসিমের প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে মেনন ইত্তেফাককে বলেন, ‘আমি যেটা বলার চেষ্টা করেছি সেটি একান্তই আমার ব্যক্তিগত মত। এটা ১৪ দলের বক্তব্য নয়। কিন্তু তারপরেও বলবো, আমি যে কথাটা বলতে চেয়েছি সেটি ১৪ দলের নেতাদের দীর্ঘদিনের অ্যাসেসমেন্টেরই একটা বহিঃ প্রকাশ।’ মেনন আরো বলেন, ‘আমার এ বক্তব্য তো নতুন নয়। নির্বাচনের পরপরই আমি এটা সংসদেও একাধিকবার বলেছি।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ১৪ দলের এক নেতা ইত্তেফাককে জানান, এবার সরকার গঠনের পর ১৪ দলের দুই-তিন জন শীর্ষ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে যান। তখন প্রধানমন্ত্রী তাদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, আপনারা বিরোধী দলের আসনে বসে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবেন, এতে সংসদ আরো কার্যকর হবে। তখন ১৪ দলের ঐ নেতারা বলেছিলেন, তাহলে কি ১৪ দল থাকছে না। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ১৪ দল থাকবে না কেন।

‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি গত নির্বাচনে দেশের মানুষ ভোট দিতে পারেনি’—মেননের এই বক্তব্য সম্পর্কে ফেসবুকে অনেকেই মন্তব্য করেছেন যে, এই বক্তব্য দেওয়ার পর মেননের উচিত সংসদ থেকে পদত্যাগ করা। এ প্রসঙ্গে ১৪ দলের এক নেতা ইত্তেফাককে বলেন, ‘বিএনপি শুরু থেকেই বলছে, ৩০ ডিসেম্বর দেশে কোনো নির্বাচন হয়নি, বর্তমান সংসদ অবৈধ। কিন্তু বিএনপি থেকে নির্বাচিতরাও এমপি হিসেবে শপথ নিয়ে সংসদে গেছেন।’

শনিবার বরিশালে ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা সম্মেলনে মেনন ঐ বক্তব্য দেওয়ার দিনই গণমাধ্যমে খবর আসে যে, বর্তমানে রিমান্ডে থাকা যুবলীগ থেকে বহিষ্কৃত ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও আরমান জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন—আরামবাগে ইয়াংমেনস ক্লাবে পরিচালিত ক্যাসিনো ব্যবসা থেকে প্রতি মাসে কয়েক লাখ টাকা করে পেতেন স্থানীয় সংসদ সদস্য (ঢাকা-৮ আসন) মেনন। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে মেনন ইত্তেফাককে বলেন, পত্রপত্রিকায় এ ধরনের প্রতিবেদন আমি দেখেছি। এ ব্যাপারে সোমবার আমরা আমাদের দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য তুলে ধরব।

মেননের ব্যাখ্যা

গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো ব্যাখ্যায় রাশেদ খান মেনন বলেন, বরিশাল জেলা পার্টির সম্মেলনে আমার একটি বক্তব্য সম্পর্কে জাতীয় রাজনীতি ও ১৪ দলের রাজনীতিতে একটা ভুল বার্তা গেছে। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই এ যাবত্কালের নির্বাচন ১৪ দলের সংগ্রামেরই ফসল এবং সরকারও গঠিত হয়েছে ১৪ দলের লড়াইয়ের মধ্যদিয়ে। আজকে মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতার যে বিপদ বিদ্যমান তাকে মোকাবিলা করতে ১৪ দলের ঐ সংগ্রামকেই এগিয়ে নিতে হবে।

তিনি বলেন—আমি কেবল এখনই নয়, জাতীয় নির্বাচন সম্পর্কে পার্লামেন্টে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছিলাম,‘একাদশ সংসদের সফল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু অভিজ্ঞতাটি সুখকর নয়। বিএনপি-জামায়াত নির্বাচনে আসলেও নির্বাচনকে ভণ্ডুল করা, নিদেনপক্ষে জাতীয় আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার কৌশল প্রয়োগ করেছে নির্বাচনে। ... এটা যেমন সত্য তেমনি এ ধরনের পরিস্থিতিতে অতি উত্সাহী প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বাড়াবাড়ি করতে পারে। কিন্তু তাতে এই নির্বাচন অশুদ্ধ বা অবৈধ হয়ে যায় না।’

মেনন বলেন, বরিশালে দেওয়া বক্তৃতায় আমি বলেছি—স্বাধীনতা-উত্তরকাল থেকে এ যাবত্ জিয়া-এরশাদ-বিএনপি-জামায়াত আমলের ধারাবাহিক অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও ক্ষমতার অপব্যবহার ঘটেছে। বিভিন্ন সময় আমি প্রার্থী হিসেবে এ সকল ঘটনার সাক্ষী। আমি বলেছি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মিলে ভোটাধিকার ও ভোটের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে আমরা যে লড়াই করেছি তা যেন বৃথা না যায় সেজন্য নির্বাচনকে যথাযথ মর্যাদায় ফিরিয়ে আনতে হবে।

ইনু যা বললেন

বরিশালে দেওয়া মেননের বক্তব্য সম্পর্কে ১৪ দলের আরেক শীর্ষ নেতা ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু গতকাল ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, এই বক্তব্যটা হঠাত্ কেন? সেই ব্যাখ্যা মেনন সাহেব দেবেন। তবে আমি বুঝতে পারিনি। রাশেদ খান মেননের দীর্ঘদিনের রাজনীতির যেই ধারাবাহিকতা—এই বক্তব্যটা (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি গত নির্বাচনে দেশের মানুষ ভোট দিতে পারেনি) সেটির বিপরীত। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন নিয়ে তার মন্তব্য সঠিক নয়। নির্বাচন হয়েছে, ভোটারও ছিল। কাজেই এ নির্বাচনকে অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। তবে এর মান-গুণ, ভালো-মন্দ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। নির্বাচনটা কত পার্সেন্ট ভালো, কত পার্সেন্ট মন্দ—সেই আলোচনা হতে পারে। তবে ভোট হয়নি, ভোটার ছিল না— এ কথা সত্য নয়। দেশে সংসদ ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়া বহাল রয়েছে। মেনন সাহেবের এই বক্তব্যে ১৪ দলের অবস্থানে কোনো হেরফের হবে না। যেই রাজনৈতিক নীতি-আদর্শ ও লক্ষ্য নিয়ে ১৪ দল গঠিত হয়েছে তা এখনো বহাল রয়েছে। সেজন্য বলি—মেনন সাহেবের এই বক্তব্য ১৪ দলের রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করবে না।

জাসদ সভাপতি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন নিজ দলের ভেতরে শুদ্ধি অভিযান চালাচ্ছেন, তখন ১৪ দলের জোটসঙ্গী বা পার্টনারদের শেখ হাসিনাকে পরিত্যাগ করার কৌশল সঠিক রাজনীতি হবে না।

‘মন্ত্রী হলে মেনন কি একথা বলতে পারতেন’?—ওবায়দুল কাদেরের এই মন্তব্য সম্পর্কে ইনু বলেন, মন্ত্রী হওয়া না হওয়ার সঙ্গে মেনন সাহেবের বক্তব্যের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তবে মেনন সাহেব নিজের অবস্থান থেকে সরে বলেছেন-গণমাধ্যম ভুল বার্তা দিয়েছে। মেনন নাকি গণমাধ্যম ভুল করেছে—সেটা মেনন ও গণমাধ্যম নিষ্পত্তি করবেন।

প্রধানমন্ত্রী ১৪ দলের শরিকদের বিরোধীদলের ভূমিকা পালনের কথা বলেছিলেন—এব্যাপারে জানতে চাইলে হাসানুল হক ইনু বলেন, প্রধানমন্ত্রী সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিতে বলেছিলেন, সরকারের মন্দ কাজের সমালোচনা করতে বলেছেন। কিন্তু মেনন সাহেব যেটা বলেছেন সেটা সমালোচনা নয়, সেটা অসত্য।

মেননকে ড. কামালের ধন্যবাদ

এদিকে, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি গত নির্বাচনে দেশের মানুষ ভোট দিতে পারেনি’—এই বক্তব্যের জন্য মেননকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। গতকাল দুপুরে রাজধানীর মতিঝিলে ড. কামাল তার চেম্বারে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকের পর সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি বারবার বলে যাচ্ছি, এ পর্যন্ত একজনও পাইনি যে একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোট দিয়েছিল। দেরিতে হলেও মেনন সত্যটা বলেছেন। আমি তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’