বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ইলেকট্রিক গাড়ির পথে হাঁটছে বাংলাদেশ

আপডেট : ১২ জুন ২০১৯, ২১:৫৬

আমদানিকারক দেশ থেকে উত্পাদনকারী দেশে পরিণত হতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে ইলেকট্রনিক্স পণ্য তৈরি করে তাতে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগ যুক্ত করতেও সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। এরই ধারাবাহিকতায় ইলেকট্রিক গাড়ি তৈরি সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান নিটল-নিলয় গ্রুপ।  পরিবেশবান্ধব ইলেকট্রিক গাড়ি তৈরিতে যেমন বিদেশি গাড়ি আমদানি কমবে ঠিক তেমনি দেশে তৈরি হবে বিশ হাজারের মতো দক্ষ অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার । এছাড়াও তরুণদের জন্য তৈরি হচ্ছে ব্যবসার নতুন প্লাটফর্ম। সারা  দেশে কয়েক হাজার ইলেকট্রিক গাড়ির রিচার্জ পয়েন্ট স্থাপন করা হবে। এতে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। সম্প্রতি এ বিষয়ে দৈনিক ইত্তেফাকের সঙ্গে কথা হয়েছে নিটল-নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল মাতলুব আহমাদের সঙ্গে। সাক্ষাত্কারটি নিয়েছেন মোজাহেদুল ইসলাম ঢেউ

 

পার্শ্ববর্তী দেশে সরকার ভর্তুকি দিয়েও গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ মানুষকে ইলেকট্রিক গাড়ি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ গাড়ি ইলেকট্রিক হওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে তারা। কিন্তু দেশে এখনো ইলেকট্রিক গাড়ি আমদানি অথবা ব্যবহারের ব্যাপারে কোনো নীতিমালা প্রণয়ন হয়নি। ব্র্যান্ড নিউ গাড়ি আমদানিকারক হিসেবে কবে নাগাদ আমরা দেশে ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যবহার শুরু হবে বলে আশাবাদী হতে পারি? এমন প্রশ্নের জবাবে নিটল-নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, ‘দেখুন শুধু পার্শ্ববর্তী দেশ নয়, বিশ্বের সব উন্নত দেশেই এখন ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। সারাবিশ্বে এখন প্রায় ৫ মিলিয়নের বেশি ইলেক্ট্রিক গাড়ি ব্যবহূত হচ্ছে। ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত প্যাসেঞ্জার কারে যার মার্কেট শেয়ার ২.১%. চীনে প্রায় ২ মিলিয়নের মতো  EV (Electric Vehicle) চলছে, এর পাশাপাশি তাঁদের রয়েছে আরো ৩.৫ লাখ ইলেক্ট্রিক বাস এবং এগুলো সবই তাদের দেশজ উপাদান। ৪৯.১% মার্কেট শেয়ার নিয়ে ইভি ব্যবহারে প্রথম স্থানে রয়েছে নরওয়ে। ২০২৫ সালের মধ্যে চীনের যানবাহনগুলোতে কোনো প্রকার কম্বাসন ইঞ্জিন থাকবে না আর ২০৩০ সালের মধ্যে ভারত তাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গাড়ি ইলেক্ট্রিক কারে রূপান্তরের পরিকল্পনা করছে। কাজেই বিশ্ব খুব দ্রুত ইলেক্ট্রিক গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পরিকল্পনার দিক থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। আর পরিকল্পনা ছাড়াতো বাস্তবায়ন অসম্ভব ব্যাপার। তাছাড়া আমাদের এখানে আমরা আটকে আছি নীতিমালায়। প্রচলিত গাড়ি আমদানি নীতিতে যে- কোনো গাড়ির অনুমোদন দেওয়া হয় ইঞ্জিন নাম্বারের  ভিত্তিতে। কিন্তু বৈদ্যুতিক গাড়িতে কোনো প্রকার ইঞ্জিন না থাকায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এগুলোর অনুমোদন দিতে পারছে না। এজন্য নীতিমালার সংশোধন খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। নিবন্ধন জটিলতা কেটে গেলে ইলেক্ট্রিক গাড়ির ব্যবহার শুরু হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।’  

বাণিজ্যমন্ত্রীকে ইলেকট্রিক গাড়ি ব্যবহারের প্রসঙ্গে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। এরপরে ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যাপারে আর কোনো বৈঠক হয়েছে কি? এ প্রসঙ্গে মাতলুব আহমাদ বলেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক গাড়ির ব্যবহার থেকে পিছিয়ে থাকতে পারে না। এটা বর্তমান সরকারের সঙ্গে মানানসই হবে না। তবে আমাদের কাজ হচ্ছে সরকারকে উদ্বুদ্ধ করা এবং জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা। গণমাধ্যমের ভূমিকা এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এবং এটা তাঁরা পালন করেও যাচ্ছে। একসময়  পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর টু স্ট্রোক ভেহিক্যালস বন্ধ করতে সংবাদমাধ্যমই সবচেয়ে বেশি কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছিল। তাই জনস্বার্থ রক্ষায় সাংবাদিকদেরকেই সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রী বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাপারে নিজেই যথেষ্ট ইতিবাচক। তিনি এ সংক্রান্ত কোনো প্রস্তাবনা পেলে বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন এবং আমরা নিজেরাও এ ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছি।’

 তিনি আরো বলেন,‘ আজকে আমি সম্পূর্ণ গাড়ি আমদানি করি অথবা এসেম্বলিং প্লান্ট করি, শুল্কহার কিন্তু কাছাকাছিই থাকছে। তাহলে স্থানীয় উত্পাদনে গিয়ে আমরা কীভাবে টিকে থাকবো? আর কীভাবেইবা নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবো? তবে বর্তমান সরকার যথেষ্ট আন্তরিক একটি শিল্পবান্ধব পরিবেশ তৈরি করছে। বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার যে লক্ষ্য নিয়ে সরকার এগোচ্ছে,সেটা বাস্তবায়নে নীতিমালা সংশোধন করে দেশীয় উত্পাদনকে উত্সাহিত করার কোনো বিকল্প নেই। খুব শিগগিরই আমরা সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এ ব্যাপারে বৈঠকের প্রস্তুতি নিচ্ছি।’ 

তিনি জানান,খুব তাড়াতাড়ি টাটা এদেশে প্রাইভেট কারের উত্পাদনে আসতে চাচ্ছে। সেক্ষেত্রে ইলেক্ট্রিক কার অবশ্যই তাদের পরিকল্পনার মধ্যে আছে। কিছুদিন আগেই টাটার কান্ট্রি ম্যানেজার সুমন্ত ভট্টাচার্য পত্রিকার এক সাক্ষাত্কারে বলেছেন, অন্যান্য দেশ যেমন নেপাল, ভুটানে বৈদ্যুতিক গাড়ির আমদানি খরচ তুলনামূলকভাবে কম আর বাংলাদেশ সরকার যদি ইলেক্ট্রিক গাড়ির ব্যাপারে ইতিবাচক থাকেন, তাহলে টাটা এ বাজারে আসতে প্রস্তুত। তাহলে দেখতেই পাচ্ছেন টাটা এখানে আসতে যথেষ্ট আগ্রহী।

টাটার ইলেকট্রিক গাড়ি বিপণনে ভবিষ্যত্ পরিকল্পনা সম্পর্কে মাতলুব আহমাদ বলেন, ‘পরীক্ষামূলকভাবে আমি কিছু ইলেক্ট্রিক কার চীন থেকে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু নিবন্ধনগত জটিলতার কারণে গাড়িগুলো রোড কন্ডিশনে টেস্ট করতে পারিনি। কারণ বর্তমান আইনে সিসিভিত্তিক রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি চালু রয়েছে। তবে বিআরটিএ বৈদ্যুতিক গাড়িকে স্বাগত জানিয়েছে। এর সেফটি বিভাগের পরিচালক রব্বানী সাহেব জানিয়েছেন, তারা ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছেন। আমরা আশাবাদী যে, খুব শিগগিরই জনগণ  দেশের রাস্তায় ইলেক্ট্রিক গাড়ি দেখতে পাবেন।’ 

বৈদ্যুতিক গাড়ি উত্পাদনের পরিকল্পনা সম্পর্কে  মাতলুব আহম্মেদ বলেন,‘ইতোমধ্যে নিটল-নিলয় গ্রুপ বাংলাদেশে বৈদ্যুতিক গাড়ি উত্পাদনের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ফেলেছে। এর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টারও কাজ শুরু করে দিয়েছে। প্রাথমিকভাবে আমরা ইলেক্ট্রিক কারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কম্পোনেন্ট বাইরে থেকে নিয়ে আসবো, কোয়ালিটির দিক থেকে যেগুলো হবে ওয়ার্ল্ড ক্লাস। যুক্তরাষ্ট্রের ডেট্রয়েটের সঙ্গে আমাদের কথা চলছে, সেখানকার ওয়েইন ইউনিভার্সিটির সঙ্গে আমরা একটি যৌথ উদ্যোগে যাচ্ছি। তাঁরা আমাদের গাড়িগুলোর টেকনিক্যাল দিকটি নিশ্চিত করবে। অর্থাত্ এই ইলেক্ট্রিক কারগুলো হবে ইউএসএ সার্টিফাইড। এছাড়াও গাড়ির রিচার্জিং সিস্টেমের ব্যাপারে জাপানের মিতশুবিশির সঙ্গে আলোচনা চলছে। আমাদের ইলেক্ট্রিক গাড়ির ধরন হবে জাপানিজ সিডান কারের মতো। গাড়িগুলো খুব সহজে, মাত্র আধা ঘণ্টায় রিচার্জ করা যাবে এবং একবার রিচার্জ করে ২০০ কিলোমিটার চলা যাবে। আর এগুলোর সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হবে ১৫০ কিমি/ঘণ্টা পর্যন্ত।’

ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যাপারে আপনার ব্যক্তিগত ইচ্ছে নিয়ে মাতলুব আহমাদ বলেন,‘আমার অনেক দিনের একান্ত ইচ্ছা, স্থানীয়ভাবে গাড়ি উত্পাদনে যাওয়া, যেগুলোকে বলা হবে ‘মেইড বাই বাংলাদেশ’।

এখানে ইলেক্ট্রিক গাড়ি সেই সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। দেশে বৈদ্যুতিক গাড়ির উত্পাদন শুরু হলে যে পদের জন্য প্রচুর চাহিদা তৈরি হবে সেটা হলো— অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার। এই ফিল্ডে দক্ষ লোক আমাদের দেশে নেই বললেই চলে। আমার একটি ব্যতিক্রমী লক্ষ্য হলো—প্রায় বিশ হাজারের মতো দক্ষ অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করা। যারা দেশে ও বিদেশে অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রির নেতৃত্ব দেবে। আমার প্রায় বিশ হাজার শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরির ইচ্ছে আছে। তাতে করে বিদেশ থেকে টেকনিক্যাল লোক নিয়োগের প্রবণতা অনেক কমে যাবে। তাছাড়া গাড়ি উত্পাদনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রচুর রিচার্জিং পয়েন্টের প্রয়োজন হবে। এই পয়েন্টগুলোতে আমি সবার আগে সুযোগ দিব কর্মহীন তরুণ-তরুণীদেরকে। যদি তাঁদের রোডের পাশে রিচার্জ পয়েন্ট করার মতো জমি থাকে, তাহলে সে আমার কাছ থেকে গাড়ির রিচার্জিং সিস্টেম নিয়ে ব্যবসা শুরু করে দিতে পারবে। এতে করে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে।’ 

মধ্যবিত্তের কথা বিবেচনায় রেখেই গাড়িগুলোকে তৈরি করা হবে যেগুলোর দাম ধরা হবে বারো লাখ টাকার মধ্যে।  জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ মধ্যবিত্তের ক্যাটাগরিতে পড়ে। তাদের জন্য গাড়ি উত্পাদনই আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য। এখন আমাদের শুধু প্রয়োজন সরকারের সহযোগিতা। যেটা পেলে আমরাই বানাতে পারব ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’গাড়ি। এমনি বলছিলেন নিটল-নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল মাতলুব আহমাদ।