বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

‘মাতৃভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা খুব গভীর হয় না’

আপডেট : ২৯ ডিসেম্বর ২০১৯, ২২:৩৩

রাজধানীর জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তন। ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকেল সাড়ে ৪টা। আমন্ত্রিত অতিথিদের আগমনে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠেছে মিলনায়তন। মঞ্চে গুণীজনদের সঙ্গে বসে আছেন বিজ্ঞান লেখক নাদিরা মজুমদার। বিজ্ঞানভিত্তিক সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য এবার ‘অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার ১৪২৬’ পেয়েছেন তিনি। গতকাল রবিবার এই অনুষ্ঠানের শুরুতেই তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয় ক্রেস্ট, সনদপত্র, আর্থিক অনুদানের চেক ও শুভেচ্ছাপত্র, পরিয়ে দেওয়া হয় উত্তরীয়। এরপর শুরু হয় আনুষ্ঠানিক আলোচনা।

আলোচনা সভার প্রধান অতিথি ছিলেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘বাংলায় নারী জাগরণের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে বেগম পত্রিকা। দীর্ঘসময় এই অঞ্চলের জনগণকে সাহস যুগিয়ে আসলেও একসময় তা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আসে অনন্যা। ৩২ বছর ধরে চলমান রয়েছে এই পাক্ষিক সাহিত্য পত্রিকা। বেগম পত্রিকা বাঙালি মধ্যবিত্ত পাঠকের চাহিদা স্মরণ করেই সেবা দিয়েছে। বেগমের পর এখন সে চাহিদা পূরণ করছে অনন্যা।’

এই অধ্যাপক বলেন, ‘দীর্ঘ ২৫ বছর ধারাবাহিকভাবে অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার দিয়ে আসছে। তাঁদের সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।’ নাদিরা মজুমদার সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘নাদিরা ভিন্ন ধরনের লেখক। সবাই শুধুমাত্র সাহিত্য নিয়ে লিখলেও নাদিরা আমাদের বিজ্ঞানকে সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে লিখে আসছেন। মাতৃভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় যে বিজ্ঞান লেখা খুব গভীর হয় না, তা নাদিরার লেখার মাধ্যমে বোঝা যায়।’

পিতৃতান্ত্রিকতার বিরোধিতা করে তিনি বলেন, ‘আমরা পিতৃতান্ত্রিক সমাজে বাস করছি। এই বিরুদ্ধ সমাজে সত্তরের দশকে নাদিরা সাইকেল চালাতো। সেই ছোট্ট নাদিরা এখন অনেক বড় হয়েছে। তাঁকে দেখে মনে হয় আমাদের মেয়েরা অনেক বড় হয়ে গেছে। পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটা নিরব বিপ্লব গড়ে উঠেছে।’

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, ‘আমি ছিলাম তার শিক্ষক। ছাত্রাবস্থায় নাদিরা বৈজ্ঞানিক রাজনৈতিক বিষয়ে তত্কালীন শিক্ষকদের সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়তেন। এমন সাহস স্বভাবত দেখা যায় না।’  সভাপতির বক্তব্যে মালেকা বেগম বলেন, ‘বিজ্ঞান বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন আছে। ক্রমান্বয়ে আমাদেরকে এই বিজ্ঞান বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটাতে হবে।’

লিখিত বক্তব্যে স্মৃতিচারণ করে নাদিরা মজুমদার বলেন, ‘আমার বাবা-মা ভাই-বোনদের মাঝে কোন বৈষম্য করেননি। আমি যখন সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেই বাবা যা আনন্দিত হয়েছিলেন তা বলবার নয়।’ পাঠকদের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি সবসময় পাঠকদের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেই। পাঠকরা যা চায় তাই নিয়ে আমি কাজ করি।  খুঁজে খুঁজে বের করে তা পাঠকদের সামনে হাজির করার নিরন্তর প্রচেষ্টা থাকে আমার।’  অনন্যার উদ্যোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের পুরষ্কৃত করার মাধ্যমে পাক্ষিক অনন্যা সাহিত্য ও বিজ্ঞান সৃষ্টিকে উত্সাহিত করেছে। এর মাধ্যমে বিস্তৃত হবে সাহিত্য ও বিজ্ঞানের আলোচনা। অনন্যার এ উদ্যোগ দেশে বিজ্ঞানভিত্তিক সাহিত্যকে মানুষের মনের ফোল্ডারে স্থান দেবে।’

বিজ্ঞান বিষয়ক  লেখিকা নাদিরা মজুমদার অনেক বছর ধরে চেক প্রজাতন্ত্রে বাসবাস করছেন। ১৯৫৩ সালের ১ মে তিনি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে তিনি ছিলেন অ্যাকাউন্টেন্ট, কম্পিউটার প্রোগ্রামার, ফাইন্যান্সিয়াল ম্যানেজার ও চেক প্রজাতন্ত্রের নীতিনির্ধারক। প্রাগস্থ জাতিসংঘের উদ্বাস্তু কমিশনের বহিরাগত কনসালট্যান্টও ছিলেন তিনি।

নাদিরা মজুমদারের প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে: ‘এই আমাদের পৃথিবী’, ‘একমেরু বনাম বহুমেরু’, ‘মহাবিশ্বে আমরাও আছি’, ‘বিমান’, ‘কৃত্রিম উপগ্রহ’, ‘আগ্নেয়গিরি ও ভূকিমম্পের কাহিনি’, ‘নানারঙের বিজ্ঞান’, ‘আইনস্টাইন সুপারস্টার’, ‘সময়, তুমি কে?’ প্রভৃতি।

প্রসঙ্গত, বাংলা ১৪০১ সালে (১৯৯৩) অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়। এর পর থেকে নিয়মিতভাবে প্রতি বছর একজন নারী-সাহিত্যিককে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এ পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত যারা এই পুরস্কার পেয়েছেন, তারা হলে: নীলিমা ইব্রাহিম, নূরজাহান বেগম, শহিদ জননী জাহানারা ইমাম (মরণোত্তর), সন্জীদা খাতুন, সেলিনা হোসেন, রিজিয়া রহমান, মালেকা বেগম, দিলারা হাশেম, রাবেয়া খাতুন, রাজিয়া খান, রুবী রহমান, পূরবী বসু, আনোয়ারা সৈয়দ হক, মকবুলা মনজুর, ঝর্ণাদাশ পুরকায়স্থ, সালেহা চৌধুরী, নূরজাহান বোস, কাজী রোজী, নিয়াজ জামান, জাহানারা নওশিন, সোনিয়া নিশাত আমিন, বেগম আকতার কামাল, বেগম মুশতারী শফি ও আকিমুন রহমান।