শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি’

আপডেট : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ২২:৫৫

বইমেলা আসলে এক বিচারে আমাদের সমাজেরই স্থিরচিত্র। সারা বছর না থাকলেও, এর রেশ থেকে যায় পুরো বছর। নতুন বন্ধু তৈরি হয়, দেখা হয় পুরোনোদের সঙ্গে। যারা বন্ধু ছিলেন অনেক ক্ষেত্রে তাদের নীচতা আর সীমাদ্ধতাগুলোও আকস্মিক-ভাবেই সামনে চলে আসে। তবু চলমান জীবনকে রেখে স্থিরচিত্রকে তো আর দোষারোপ করা চলে না। সবাই আশা রাখি, সামনের বছরটি বোধ হয় আলাদা হবে। সুরুচি, ন্যায়বোধ আর একে অপরকে সম্মান করার প্রবণতা শক্তিশালী হবে। সবার মধ্যে সমতা          বাড়বে, সৌজন্যবোধ ফেরত আসবে। চাটুকারিতা আর পদলেহনের বদলে যোগ্যতা আর দূরদৃষ্টি নিজস্ব জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হবে। ভিন্নমতাবলম্বীরা নির্বাসিত আর নিগৃহীত হবেন না। জাতি হিসেবে তলানি থেকে উঠে আসার এছাড়া আমাদের আর কোনো পথ আছে বলে আমার মনে হয় না। অতএব বইমেলা আর সমাজমেলা দুটোই বন্ধনহীনভাবে সামনে এগোবে, সেটাই সবাই চাই। কিন্তু এ চাওয়ার সঙ্গে প্রাপ্তিযোগ কখন ঘটবে সেটা অবশ্য অনেকাংশেই পরের প্রজন্মের ওপর নির্ভর করছে।

এবারের বইমেলাটি দেখে বরাবরের মতো আবারও বলতে ইচ্ছে করে, প্রকাশনা এদেশে শিল্প হতে এখনো ঢের বাকি। পেশাদারিত্ব, পারম্পর্য বা ফলো থ্রু, ঝুঁকি নেবার সাহস আর প্রতিভা চেনার ক্ষমতা খুব বেশি প্রকাশকের এখনো তৈরি হয়নি। প্রকাশক পণ্ডিত হবেন, এমনটা কেউ আশা করে না। কিন্তু নির্বোধ আর মুদি দোকানির আচরণ করবেন, সেটাও কাম্য নয়। আর বেশির ভাগ লেখকেরই আর যা-ই হোক, আত্মজ্ঞান আছে বলে মনে হয় না। প্রত্যেকের মধ্যেই অন্তত একটি গ্রন্থ লুকিয়ে থাকে সেটি আমরা জানি। কিন্তু সবকিছুকেই প্রকাশ্যে নিয়ে আসা আর জোর করে সবাইকে তার অংশ করতে চাওয়া আসলে একধরনের ধৃষ্টতা। তারুণ্য বা বার্ধক্য কোনো বিবেচনাই আসলে আমাদেরকে যথেচ্ছ আচরণের, পরীক্ষানিরীক্ষার নামে প্রায় চতুষ্পদের মতো আচরণের অনুমতি দেয় না। আর বিপণনের উভয় সংকটের কথা আর নাই-বা বললাম।

এবারের মেলায় আমার একটি বই ‘চল বিশাখা, বিষুব ছেড়ে’ বের হয়েছে। অনুবাদ হিসেবে দ্বিতীয় আর গ্রন্থ হিসেবে ষষ্ঠ (অবশ্য এর মধ্যে ‘মধুরেণ’ নামক কাব্যনাট্যটি আমার এক ঘনিষ্ঠজনের কলমের ওপর অর্ধেক দাঁড়িয়ে আছে।)‘চল বিশাখা, বিষুব ছেড়ে’ বলতে গেলে আমার প্রথম অনুবাদ বইটির দ্বিতীয় পর্বই বলা চলে। দুই ডজন কবির প্রতিনিধিত্বমূলক কিছু কবিতা এখানে স্থান পেয়েছে। আর প্রথম অনুবাদের বই ‘দূর দ্রাঘিমায়’ ভিন্ন ২৫ জনের কবিতা মলাটবন্দি হয়েছিল। অনেকের আগ্রহ দেখে নিকট ভবিষ্যতে তৃতীয় একটি বৃহত্তর খণ্ড বানানোর কথা ভাবছি। সবাইকে বলে নেওয়া ভালো, এদের সবাই মহিলা কবি। অত্যন্ত সচেতনভাবেই এদের বেছে নেওয়া হয়েছে। কোনো ‘বাদ’-এর প্রতিভূ হিসেবে নয়, মানবজাতির অর্ধেকের অংশীদারিত্ব যে পৃথিবী মেনে নেবে না, সে পৃথিবীর অস্তিত্ব সংকট চিরকালই মহাজাগতিক হুমকি হিসেবে থেকে যাবে—এ বিবেচনায়। মেলায় আর একটি বই, যুগলবন্দিতে লেখা ‘খোঁজ—একটি কাব্যোপন্যাস’ আসবার কথা ছিল। আমার সতীর্থ, পরমাত্মীয় বন্ধু আর সহলেখক কবি আফতাব আহমদ কোনোমতেই এটি তাড়াহুড়ো করে শেষ করতে চাননি। তার বিবেচনায় সম্ভাবনা নষ্ট করে বই বের করার চেয়ে না-লেখাই যথার্থ। মেলার পর কোনো একসময় এটি প্রকাশিত হবে। তাছাড়া শুধু মেলানির্ভর প্রকাশনার এই প্রবণতা থেকেও তো আমাদের বের হয়ে আসা দরকার, তাই না?