বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে এখনই যা জরুরি

আপডেট : ২২ মার্চ ২০১৯, ২৩:০৩

রাজধানীতে বেপরোয়া বাসের চাপায় সর্বশেষ গত মঙ্গলবার প্রাণ হারিয়েছেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) মেধাবী ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরী। এর আগে গত বছরের ২৯ জুলাই জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাসের চাপায় মারা যান রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী আবদুল করিম রাজীব ও দিয়া খানম মিম। দু’টি ঘটনার পরই প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। কিছু উদ্যোগও নেয়। তবু সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো যায়নি। সড়ক নিয়ে গবেষণা করেন, এমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর জন্য মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন এখনই কিছু উদ্যোগ নেওয়া।

এ প্রসঙ্গে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ ইত্তেফাককে বলেন, ‘নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সবচেয়ে বড় দরকার রাস্তা বাড়ানো। সেটা তো আর আমরা পারছি না। তাহলে আমাদের এখনই কিছু করণীয় ঠিক করতে হবে। এর মধ্যে প্রথমত ফুটপাত চলাচলের জন্য ফ্রি করতে হবে। প্রতিটি রাস্তার মাঝে যে ডিভাইডার আছে সেটাতে রেলিং দিয়ে রাস্তা পারাপার বন্ধ করতে হবে। শুধু নির্দিষ্ট জায়গায় বাস থামার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ হলো ড্রাইভাররা যদি কোনো ট্রেনিং স্কুল থেকে না আসেন তাহলে তাকে লাইসেন্স দেওয়া যাবে না। এ ছাড়া প্রত্যেক ড্রাইভারের নিয়োগপত্র থাকতে হবে। কারণ তারা ১৫ দিন গাড়ি চালায়, সেই বেতন দিয়ে পুরো মাস চলতে হয়। ফলে শুধু ড্রাইভারদের উপর চাপ দিলেও হবে না, পুরো সিস্টেমটা বদলাতে হবে।’ বুয়েটের এআরআইর গবেষণা থেকে জানা গেছে, ২০১৬ সালের মার্চ থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৬৬টি দুর্ঘটনায় ৬৯৯ জন নিহত এবং এক হাজার ২২৭ জন আহত হয়েছে। এর মধ্যে ৩৫৪টি দুর্ঘটনাই বাসের কারণে ঘটেছে। এ ছাড়া ১৩০টি মোটরসাইকেল, ১১৩টি ট্রাক, ৭৩টি পিকআপ এবং ৫৬টি ব্যক্তিগত গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। এর মধ্যে ২০১৬ সালের মার্চ থেকে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত শুধু রাজধানী ঢাকায় ১২৩টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৩৭ জন, আহত হয়েছেন ৩৩৭ জন। ২০১৭ সালে ঢাকায় ২৬৩টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৭৬ জন। ৩৫৮ জন আহত হন। ২০১৮ সালে ঢাকায় ২৮০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৮৬ জন নিহত হন। আহত হয়েছিলেন ৫৩২ জন। এ বছর ১৩৪টি দুর্ঘটনার কারণ ছিল বাস।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মীর রেজাউল আলম ইত্তেফাককে বলেন, ‘রাজধানীতে এমনিতেই রাস্তা অনেক কম। তার উপর উন্নয়নমূলক কাজ চলার কারণে, বিশেষ করে মেট্রোরেলের কারণে রাস্তার মাঝখানে ১১ ফুট জায়গা ছেড়ে দিতে হয়েছে। ফলে সংকুচিত হয়ে পড়েছে রাস্তা। তারপরও আমরা রাজধানী সচল রেখেছি।’ নানা ধরনের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে এখনই কী করণীয়— জানতে চাইলে মীর রেজাউল বলেন, ‘আমি বলব, ঢাকার রাস্তা থেকে যানবাহন কমাতে হবে, মানুষ কমাতে হবে। কিন্তু এগুলো আর সম্ভব নয়, তাই আমাদের প্রথমত চালকদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। যদিও তাদের মোটিভেট করতে আমরা নানা ধরনের কাজ করছি। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার মহানগর নাট্যমঞ্চে এক হাজারের মতো বাস শ্রমিককে নিয়ে মোটিভেশনাল প্রোগ্রাম করেছি। এ কাজ প্রতিদিনই চলছে। পাশাপাশি পথচারীদের মধ্যে আইন মেনে চলার প্রবণতা তৈরি করতে হবে। কারণ আমাদের দেশের অশিক্ষিত মানুষই কিন্তু বিদেশে গিয়ে শৃঙ্খলা মেনে চলেন। তাহলে এখানে কেন সম্ভব নয়? ফুটপাত হাঁটার জন্য উন্মুক্ত করতে হবে। যে কোনো জায়গায় হুট করে রাস্তা পার হওয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। আসলে সবাই যদি আইন মানেন তাহলে তো পরিস্থিতি অনেকখানি এমনি বদলে যাবে।’

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক রাজধানীতে ৬টি কোম্পানির মাধ্যমে ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিত্তিতে বাস চলাচলের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এতে চালকদের প্রতিযোগিতার প্রবণতা অনেক কমে যাবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাতে দুর্ঘটনাও কমবে। এ ছাড়া ট্রাফিক আইন অমান্যে প্রয়োজনে জরিমানা দ্বিগুণ করার বিষয়টিও বলছেন কেউ কেউ।

আনিসুল হকের উদ্যোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম ইত্তেফাককে বলেন, ‘অনেকদিন ধরেই এ উদ্যোগটা বন্ধ ছিল। এখন আমরা ওই পরিকল্পনাটা আবার বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছি। গত বুধবার এটা নিয়ে একটা বৈঠকও হয়েছে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। ছাত্ররা রাস্তায় থাকায় তাদের সঙ্গে আমাকে থাকতে হয়েছে, ফলে আমি যেতে পারিনি। তবে মেয়র সাঈদ খোকনের সঙ্গে আমি কথা বলে এটা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেব।’ এটা করতে তো লম্বা সময় লাগবে, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে এখনই কী করা প্রয়োজন— জানতে চাইলে মেয়র আতিকুল বলেন, ‘আসলে অনেক জায়গায় দ্রুত ফুটওভারব্রিজ করা দরকার। এগুলো করতে বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান তাদের সিএসআরের ফান্ড থেকে টাকা দিয়ে আমাদের সহযোগিতা করতে পারে। আমরা তাহলে ওই ফুটওভারব্রিজটি তার নামে বা তার প্রতিষ্ঠানের নামে করে দিতে পারি। এ ছাড়া ফুটপাতটা হাঁটার জন্য উন্মুক্ত করা দরকার। কিছু কাজ আমরা শুরু করছি, আমি তো মাত্র এলাম, আশা করি কিছু উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারব।’ 

অদক্ষ চালকদের মধ্যে যাত্রী নেওয়ার প্রতিযোগিতা ঢাকায় দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। ইত্তেফাককে তিনি বলেন, ‘ঢাকার নানা কোম্পানির নামে চলাচলকারী বাসগুলো বিভিন্ন মালিকের। এজন্য তারা প্রতিযোগিতা করে। তারা একটি কোম্পানির নাম নিয়ে চলে। দৈনিক চুক্তিতে চলাচলের কারণে এগুলো প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। যে কারণে দুর্ঘটনা বেশি হয়। আমাদের কাউন্টার সিস্টেম নাই, ফলে দিন শেষে চালক যে টাকা দিত মালিককে তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হতো। এখন মালিকরা চালকদের সঙ্গে চুক্তিতে চলে গেছে। এ কারণে চালকরা বেশি আয়ের আশায় প্রতিযোগিতা করছে। এটা বন্ধ করতে হবে। তা ছাড়া ঢাকা শহরে  বেশির ভাগ চালকই পাকা লাইসেন্সধারী না, অনভিজ্ঞ। তারা লেগুনা, পিকআপসহ হালকা যানবাহনের চালক। ভারী লাইসেন্সধারী চালকরা ঢাকায় গাড়ি চালাতে আসে না। ফলে দক্ষ চালকের অভাবে মালিকরা তাদের (অদক্ষ) হাতেই গাড়ি তুলে দিচ্ছে। ফলে দুর্ঘটনা ঘটছে।’

এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ কী— জানতে চাইলে এই পরিবহন নেতা বলেন, ‘আমরাও তো চেষ্টা করে পারছি না। এখনও ২০ ভাগের বেশি গাড়ি চালকের অভাবে প্রতিদিন রাস্তায় নামানো যাচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়েই আমরা এত টাকার গাড়ি অদক্ষ চালকদের হাতে তুলে দিচ্ছি। আমরাও চাই সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসুক, মানুষ নিরাপদে চলাফেরা করুক। কোনো মালিক কি চাইবেন তার এত টাকার গাড়ি কাউকে চাপা দিক, আর জনতা সেই গাড়ি ভাঙচুর করুক বা আগুন দিক? কেউ চান না। আপনার মতো আমিও চাই সব মানুষ নিরাপদে ঘরে ফিরুক।’