বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

গ্যাস সিলিন্ডার দুর্ঘটনা এড়াতে প্রয়োজন সচেতনতা

আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০১৯, ২১:৪৯

দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত কমে আসায়, এলপি গ্যাসের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। দেশে বছরে এলপি গ্যাসের চাহিদা রয়েছে প্রায় দেড় লাখ টন। শিল্পায়নের ফলে চাহিদা আরো বাড়ছে। রান্নার কাজে এলপিজি ব্যবহার শুরু হয় ২০০৫ সালে। পাইপলাইনে বাসাবাড়িতে গ্যাস-সংযোগ বন্ধের পর এলপিজির ব্যবহার আরো বেড়ে গেছে। বসতবাড়ি ছাড়াও হোটেল, রেস্তোরাঁ, বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও মোটরগাড়িতে এলপি গ্যাসের ব্যবহার রয়েছে। পাঁচ বছর আগে এর ব্যবহার ছিল ৮০ হাজার মেট্রিক টন। আগামী পাঁচ বছরে এলপি গ্যাসের ব্যবহার বেড়ে ২ মিলিয়নে পৌঁছাবে।

কিন্তু গ্যাস সিলিন্ডারের মান নিয়ন্ত্রণে নির্ধারিত নীতিমালা থাকলেও নেই কোনো প্রয়োগ। কারিগরি ত্রুটি, অসচেতনতা ও অসতর্কতার ফলে এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। দুর্ঘটনায় অপমৃত্যুর তালিকায় গ্যাস সিলিন্ডার দুর্ঘটনা এখন শীর্ষের দিকে।

ফায়ার সার্ভিস বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী গত বছরে (২০১৮ সাল) বাসগৃহ ও রান্নাঘরে অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা ৭ হাজার ২১৬টি, যা কারখানা ও গুদাম (১ হাজার ২৮১টি), দোকান-বাজারের (৩ হাজার ৩১১টি) থেকে অনেক বেশি। গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। প্রথমত, সিলিন্ডার রাখার জন্য নিরাপদ জায়গা নির্ধারণ। দ্বিতীয়ত, রান্না শুরু করার আগে ও পরে গৃহীত সতর্কতা। তৃতীয়ত, রেগুলেটরসহ সিলিন্ডারের খুঁটিনাটি সব পরীক্ষা করে রান্নাঘরে যথাযথ ভ্যান্টিলেশনের ব্যবস্থা করা। সিলিন্ডারের মুখে রেগুলেটর লক হয়ে একটি রাবারের সিল চেপে থাকে। ব্যবহারকারীরা চুলার সুইচ বন্ধ করলেও অজ্ঞতার কারণে রেগুলেটর সুইচ বন্ধ করেন না। যার কারণে সিলিন্ডারের গ্যাস বের হয়ে রাবারের সিলে চাপ সৃষ্টি করে এবং গ্যাস লিক করে চুলার আগুনের সংস্পর্শে এসে বিস্ফোরণ ঘটায়। পেশাদার কর্তৃপক্ষ ও বিশেষজ্ঞ মহলকে এ দুর্ঘটনা রোধে আরো উদ্যোগী হতে হবে এবং ব্যবহারকারীদের ভেতর সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।

‘এলপিজি বিধিমালা, ২০০৪’-এর তৃতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে, কোনো লাইসেন্সধারী লাইসেন্সযোগ্য পরিমাণ এলপিজি লাইসেন্স প্রাপ্ত নন, এমন কাউকে দিতে পারবেন না। কিন্তু কোনো প্রকার লাইসেন্স ছাড়াই এলপি গ্যাস ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে। ‘গ্যাস সিলিন্ডার বিধিমালা, ১৯৯১’-এর চতুর্থ পরিচ্ছেদে বলা হয়েছে, গ্যাস পূর্ণ সিলিন্ডার কোনো দ্বিচক্রযানে পরিবহন করা যাবে না, কোন যানে সিলিন্ডার পরিবহনের ক্ষেত্রে সিলিন্ডারের কোনো অংশ উক্ত যানের বাইরে থাকা যাবে না। গ্যাস পরিবহনেও রয়েছে আমাদের অসচেতনতা। জনাকীর্ণ স্থানে গ্যাস সিলিন্ডার আঘাতপ্রাপ্ত হলে কিংবা পড়ে গেলে ঘটতে পারে ব্যাপক প্রাণহানি।

গ্যাস-পাইপলাইনের বিভিন্ন ত্রুটির কারণেও হতাহতের ঘটনা ঘটছে। ঢাকা শহর ও এর আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় অবৈধভাবে গ্যাস-সংযোগ নেওয়া হয়। এসব গ্যাস-পাইপলাইনে কারিগরি ত্রুটি থাকে, পাইপলাইনের লিকেজের কারণে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনা এড়াতে ডিলারসহ গ্রাহকদের নিয়ে প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার ব্যবস্থা করতে হবে।

রান্নার পাশাপাশি মোটরযানেও রয়েছে গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবহার। সিলিন্ডার দুর্বল বা মেয়াদোত্তীর্ণ হলে বাস-ট্রাকে বড়ো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। বাস-ট্রাকে সাধারণত ছয় থেকে আটটি সিলিন্ডার থাকে। গ্যাস ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য গাড়ির মালিক নিম্নমানের প্রতিষ্ঠান থেকে কম মূল্যে গ্যাস সিলিন্ডার ক্রয় করে গাড়িতে সংযোজন করেন। কম মূল্যের বাড়তি সিলিন্ডারটি অন্যান্য ভালো সিলিন্ডারগুলোকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়। যার কারণে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে।

পাঁচ বছর পরপর সিলিন্ডার রি-টেস্ট করার বিধান থাকলেও অনেক ব্যবহারকারী বিষয়টি এড়িয়ে যান। তিন বছর আগে বিস্ফোরক অধিদপ্তর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের ১১ হাজার গ্যাস সিলিন্ডার পরীক্ষা করেছিল, যার ভেতর ৮ হাজার সিলিন্ডারই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এ থেকে সহজে বোঝা যায়, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঝুঁকি কতটা ব্যাপক। বিস্ফোরক অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দেশে নিবন্ধিত ২৫ লাখ যানবাহনের ভেতর গ্যাস সিলিন্ডার পরীক্ষার প্রতিবেদন জমা দেয় মাত্র ১৪ থেকে ১৫ হাজার যানবাহন।

মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার ব্যবহার বন্ধ করতে কঠোর নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে। একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর প্রতিটি সিলিন্ডার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। পুরোনো গাড়ি ক্রয় করার সময় সিলিন্ডারসংক্রান্ত ডকুমেন্ট ঠিক আছে কি না, তা বুঝে নিতে হবে। গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারকারীগণ সিলিন্ডার ক্রয় করার সময় নির্ধারিত নীতিমালা মেনে চললে এবং ব্যবহারের সময় সচেতনতা অবলম্বন করলে দুর্ঘটনা অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব।

n লেখক : শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়