আমাদের সমাজে বীরের সংখ্যা অতি অল্প, যারা তা দেখাতে পারেন তাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জাগে আপনা থেকেই। তেমনই একজন শ্রদ্ধেয় বীরের নাম রণদা প্রসাদ সাহা। তার সুদীর্ঘ কর্মময় জীবন, নীতি-আদর্শ, অপার মানবিকতা, সমাজ চেতনা এবং দেশপ্রেমের কথা স্মরণ করার মাধ্যমে আজকের যুগে তিনি যে কত বেশি প্রাসঙ্গিক—সেটাই বলার বিষয়।
আমার প্রজন্মের কেউ শ্রদ্ধেয় রণদাপ্রসাদ সাহাকে কখনো চোখে দেখিনি। কর্মসূত্রে তার প্রতিষ্ঠিত কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঐতিহ্যবাহী ভারতেশ্বরী হোমসে যখন এলাম তখন অন্তর থেকে উপলব্ধি করতে লাগলাম একটি বিশ্বাস ও ভালোবাসার নাম রণদা প্রসাদ সাহা! কুমুদিনীতে এলে ঘুচে যায় মনের অনেক দৈন্য, বৈকল্য। রণদা প্রসাদ ছিলেন উচ্চতর মূল্যবোধের অধিকারী এক বিস্ময়কর রকম শক্তিমান মানুষ। বিস্ময়কর ছিল তার শ্রমশক্তি ও চিন্তাশক্তি। তিনি তার কীর্তির চেয়েও অনেক বড়ো।
১৮৯৬ সালের ৭ মে তারিখে জন্ম নেওয়া রণদা প্রসাদ সাহার জীবন শুরু হয়েছিল কঠিন জীবনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। কিশোর বয়সে সে যুদ্ধ ছিল অতিশয় নির্মম। সাফল্য পেয়েছিলেন, যে কোনো বিবেচনায় তা অসামান্য, প্রায় রূপকথার মতোই। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি ছেলে মায়ের অকাল মৃত্যুর পর যাকে আশ্রয়হীন, ঠিকানাহীন করে তোলে। বাবার অবহেলা সত্মায়ের যন্ত্রণা, আত্মীয়স্বজনের স্নেহহীন দৃষ্টি তাকে বহেমিয়ান করে তোলে। লেখাপড়া হলো না। বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে যান সুদূর কলকাতায়। কষ্টসহিষ্ণুতা, সাহস ও কর্মনিষ্ঠাই ছিল পুঁজি।
জীবনযুদ্ধ থেকে পৃথিবীর প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। সেখানেও অকুতভয় বীরের পরিচয় দিলেন। যুদ্ধশেষে রেলওয়ে বিভাগের সামান্য চাকরি। সে চাকরিও ছাড়তে হলো কোনো এক চক্রান্তে পড়ে। কিন্তু ছাড়ার দরুন সরকারের কাছ থেকে পেলেন কিছু ক্ষতিপূরণ। সেই সামান্য পুঁজি সম্বল করে শুরু করলেন ব্যবসা। প্রথমে বাড়ি বাড়ি পরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, এরপর জাহাজে কয়লা সরবরাহ করতে লাগলেন। এর পরের গল্প কেবলই সাফল্যের। নারায়ণগঞ্জে রণদা প্রসাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, উপার্জনের। আর খরচ করেছেন মির্জাপুরে—সেবা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। রণদা প্রসাদ মানুষকে যা দিয়েছেন, তা ভিক্ষারূপে দেননি, ঋণ হিসেবেও দেননি, দিয়েছেন তাদের প্রাপ্য হিসেবে। বিশ্বাস করতেন ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’। তাকে কাছ থেকে দেখা মানুষদের আলোচনা থেকে জানা যায়, ছোটোর জীবনকে সামনে রেখেই তিনি অর্থ উপার্জন করেছেন। আবার সেই অর্থ যখন সর্বসাধারণের জন্য কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট (১৯৪৭)-এর মাধ্যমে দান করেছেন তখন কোনো আত্মগরিমা তাকে স্পর্শ করেনি। এজন্যই সারাজীবন তিনি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন।
একদিন যে অমানবিক সমাজ রণদা প্রসাদের মা কুমুদিনীর জীবন অকালে কেড়ে নিয়ে ছিল (১৯০৩) সেই সমাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন আজীবন। এই সমাজের প্রতি তার অশেষ ঘৃণা ছিল, কিন্তু প্রতিশোধ স্পৃহা পরিণত হয়ে ছিল সমাজ বদলের সংকল্পে। এটা ছিল তার দ্বিতীয় যুদ্ধ। বিনা পয়সায় তৃণমূল মানুষের কাছে চিকিত্সাসেবা ও মেয়েদের জন্য শিক্ষা পৌঁছে দেওয়া। যে সমাজ-সংসার থেকে তিনি একদিন উচ্ছেদ হয়েছিলেন, প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেই সমাজেই ফিরে এসেছিলেন। সমাজ পারলে তাকে একঘরে করে ছাড়ত। হয়তো ফিরে যেতে হতো, কিন্তু সংবেদনশীল রণদা প্রসাদ স্বোপার্জিত অর্থসম্পদ ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে সমাজের বিরুদ্ধে একরকম বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। ত্রিশের দশকেই বিনা খরচে মেয়েদের জন্য উচ্চশিক্ষার দ্বার খুলে দিতে ভারতেশ্বরী হোমস (১৯৩৮), টাঙ্গাইলে কুমুদিনী মহিলা ডিগ্রি কলেজ (১৯৪৩) প্রতিষ্ঠা করলেন। সবটুকু আয়োজন গ্রামের দরিদ্র মানুষদের ঘিরে এবং তাদেরই প্রয়োজনে।
রণদা প্রসাদ বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন আরো একটি জায়গায়, ১৯৩৮ সালে মির্জাপুর গ্রামে কুমুদিনী হসপাতাল স্থাপন করে। অবহেলিত, বিধাবা, স্বামী পরিত্যক্ত মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কুমুদিনী হাসপাতালে নার্স হিসেবে নিয়োগ দিতেন। তার সংবেদনশীল মনের পরিচয় পাই আরো এটি জায়গায়। কৈশোরে যে সত্মায়ের বৈরী আচরণে তিনি বাড়ি ছাড়া হয়েছিলেন পরবর্তী জীবনে তার ভেতরেই তিনি একজন বঞ্চিতা নারীর মুখচ্ছবি দেখেছিলেন। রণদা প্রসাদ জানতেন পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থান কতটা শোচনীয়। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে সেই মায়ের জন্য মনের মধ্যে জায়গা করে দিয়েছেন সম্মানের উচ্চস্থান।
১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে ৭ মে তিনি পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের হাতে অপহূত হন পুত্রসহ। যুদ্ধের শুরুতেই স্বজনেরা পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু তিনি পালিয়ে যাবার মানুষ ছিলেন না। সারাজীবনের সাহসী-সংগ্রামী মানুষটি এখানে এসেই গুপ্তঘাতকদের হাতে বরণ করেছেন বীরের মতো। মৃত্যুতে তিনি শেষ হয়ে যাননি।
আত্মপ্রচারে উত্সাহী ছিলেন না রণদা প্রসাদ। তিনি জানতেন কাজই তার আত্মপ্রকাশ ও আনন্দ। আজ ১৫ নভেম্বর তার ১২৩তম জন্মদিন। রণদা প্রসাদের কর্মময় জীবন, নীতি ও আদর্শ, অপার মানবিকতা, সমাজ চেতনা, দেশপ্রেম আমাদের নিরন্তর অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে। তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
n লেখক : শিক্ষক, ভারতেশ্বরী হোমস,
মির্জাপুর, টাঙ্গাইল