আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপারে প্রশ্ন করতে পছন্দ করে। আপনি যতই অপছন্দ করুন না কেন, ব্যক্তিগত নানা খুঁটিনাটি বিষয়ে প্রশ্ন আপনাকে শুনতেই হবে। অনেকে কৌতূহলের বশে এসব প্রশ্ন করেন। কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে প্রশ্ন করা যে উচিত নয়, এই অজ্ঞতা থেকে কেউ কেউ এসব প্রশ্ন করেন। তবে বেশির ভাগ মানুষ জেনেবুঝেও অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামান। আসলে তাদের স্বভাবই হচ্ছে অন্যের ব্যক্তিগত জীবনে নাক গলানো।
গুলতেকিন খানের কথাই ধরা যাক। গত ১৩ নভেম্বর ছিল বরেণ্য লেখক হুুুমায়ূন আহমেদের ৭১তম জন্মবার্ষিকী। চারদিকে যখন প্রিয় লেখকের জন্মোত্সবের আয়োজন চলছে, তখনই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে লেখকের প্রাক্তন স্ত্রী গুলতেকিন খানের বিয়ের খবর!
তার বর আমলা ও কবি আফতাব আহমদ। এই নিয়ে মানুষের উত্সাহের শেষ নেই। কতজন যে কত বিচিত্র কথামালা দিয়ে এই বিয়ের পক্ষে-বিপক্ষে অজস্র কথামালা রচনা করছেন! যেন এটা একটা জীবন-মরণ সমস্যা। এ বিষয়ে কিছু না কিছু বলতেই হবে!
এই বিয়ের ব্যাপারে কবি আফতাব আহমদ সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘গুলতেকিনের সঙ্গে বিয়ের খবর গোপন কিছু নয়। তবে বিষয়টি একান্ত ব্যক্তিগত। এই খবরটি অনেকের সম্মানের সঙ্গে জড়িত। সাংবাদিকরা সেটুকু মাথায় রাখলে আমরা কৃতজ্ঞ থাকব।’
কিন্তু কীসের কী, কীসের ব্যক্তিগত বিষয়! এই ‘ব্যক্তিগত’ বিষয়টি নিয়েই সবাই অকাতরে নাক গলিয়ে যাচ্ছে। এটা অবশ্য আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ লিখেছিলেন, ‘অন্যদের সমস্ত কিছুতে নাক গলাতে বাঙালি শুধু পছন্দই করে না, এটাকে কর্তব্য ব’লে গণ্য করে। বাঙালি তার এলাকার সকলের সমস্ত খবর রাখে, খারাপ খবরগুলো মুখস্থ রাখে; এবং যদি কারো কোনো খারাপ খবর না থাকে, তবে বাঙালি তার একটা খারাপ খবর তৈরি করে। বাঙালি অন্যের ব্যক্তিগত জীবনে বিশ্বাস করে না। বাঙালি অন্যের একান্ত বা ব্যক্তিগত কিছু সহ্য করে না। তাই বাঙালির কোনো ব্যক্তিগত জীবন নেই। বাঙালির চোখে ব্যক্তিগত জীবন পাপ; বাঙালি মনে করে দরোজা লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে মানুষ পাপকর্মে লিপ্ত হয়; তাই তার দায়িত্ব অন্যের দরোজা ভেঙে ঢুকে তাকে পাপ থেকে উদ্ধার করা। তবে বাঙালি উদ্ধার করে না, অন্যকে বিপদে ফেলাই তার সমস্ত উদ্বেগের উদ্দেশ্য।’
আমাদের স্বভাব অবশ্য বড়োই বিচিত্র। আমরা অন্যের ব্যাপারে শুধু নাক গলাতেই পছন্দ করি না, এক ধরনের সমালোচনা, পরস্পরবিরোধী মন্তব্য করতেও ওস্তাদ! ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, একেবারে ছোটোবেলায় যেদিন একটু বেশি পড়তাম, মা-সহ অনেকেই বলতেন, ইস, উনি যেন বিদ্যাসাগর হবেন! সারা দিন শুধু পড়া আর পড়া। কেন, একটু খেলতে পারো না! চোখ দুটোকেও তো একটু রেস্ট দিতে হয়! আর যখন খেলে ফিরতাম, তখন শুরু হতো বিপরীত বক্তব্য : ফিরলে কেন? যাও আরো খেলো। তোমাদের তো লেখাপড়া নেই, অন্য কোনো কাজও নেই! খেলোয়াড় হওয়ার জন্য জন্ম হয়েছে যেন!
দুপুরে যখন ঘুমাতে চাইতাম না, তখন কড়া ধমক, সারা দিন শুধু টইটই করে ঘুরে বেড়ানো। একটু চোখটা বন্ধ করতে পারো না? শরীররটা তো আরামও চায়, নাকি?
যদি খেতে চাইতাম অমনি বলা হতো, এই ঘরে কোত্থেকে এক রাক্ষস এসে জুটেছে, সারাক্ষণ কেবল খাইখাই করে। কেন, তুমি কয়দিন ধরে না খেয়ে আছ? হাভাতে ঘরের সন্তানরা এমন স্বভাবের হয়। আবার যখন কোনো একটা কিছু খেতে মন চাইত না, তখনই বলা হতো, তুমি কি লাটসাহেবের নাতি হয়েছ নাকি? গলা দিয়ে কিছু নামে না! না খেলে শরীরটা ভালো থাকবে কীভাবে? তোমাদের তো আবার জ্বালানোর স্বভাব! না খেয়ে কিছু একটা অসুখ বাধিয়ে পরিবারের সবাইকে না ভোগালে চলবে কেন?
এরপর যতই বড়ো হয়েছি, ততই দেখেছি, ব্যক্তিগত ব্যাপারে পরিবারের বাইরের মানুষের নাক গলানোর ব্যাপ্তি। আমাদের গ্রামের বাড়ির ধারেকাছে একটাই প্রাইমারি স্কুল ছিল। আর হাইস্কুলও ছিল একটাই। কাজেই কোন স্কুলে ভর্তি হব—এই প্রশ্ন শুনতে হয়নি। কিন্তু স্কুল পাশ দেবার পর থেকেই শুরু হয় প্রশ্ন : কোথায় ভর্তি হচ্ছ? এলাকাতেই থাকবে, নাকি ঢাকায় যাবে? অবশ্য ঢাকায় ভর্তি হওয়া খুব কঠিন। তোমার যা রেজাল্ট, তাতে আর কতদূরই-বা যেতে পারবে!
কলেজ-জীবন শেষে আবারও প্রশ্ন : কোন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবে? মেডিক্যাল-বুয়েটে ট্রাই করোনি? ও, তুমি সাইন্স বাদ দিয়ে আর্টসে চলে এসেছ? তাহলে আর কি! এখন ইউনিভার্সিটিতেই পচে মরো! তা কোন ইউনিভার্সিটিতে পরীক্ষা দিচ্ছ? চান্স পাবে কি না জানি না, তবে ঢাকা ইউনিভার্সিটিকে টার্গেট করো। ঢাকা না হলে জাহাঙ্গীরনগর দেখো।
ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাবার পর আবার প্রশ্ন :কোন সাবজেক্টে চান্স পেয়েছ? অর্থনীতি অথবা ইংরেজিতে পড়তে পারলে না? রাষ্ট্রবিজ্ঞান বাংলা, দর্শন—এসব সাবজেক্টে পড়ে কোনো লাভ নেই। এসব সাবজেক্টে গাধারা পড়ে!
কিছুদিন যাবার পর শুরু হলো আরেক উত্পাত। অনেকেই প্রশ্ন করা শুরু করল, কি বান্ধবী-টান্ধবী কিছু জোটাতে পারলে? নাকি চোখের দেখাতেই মনের সুখ? সে সময় এটাও দেখেছি, যে প্রেম করে তার সম্পর্কে বলা হচ্ছে : ছেলেটা একটা লম্পট। প্রেমট্রেম করে একেবারে গোল্লায় গেল। আর যার কপালে প্রেম জোটেনি তার সম্পর্কে বলা হচ্ছে, ছেলেটা একটা ঘোড়েল মাল। ডুবে ডুবে পানি খায়। ও এত চালাক যে ওর প্রেম-ট্রেমের ব্যাপারগুলো কাকপক্ষীও টের পায় না। আবার কারো সম্পর্কে এমনও শুনেছি যে, ও আর প্রেম কী করবে? ও তো পুরাই একটা আবুল। ও পারে কেবল বাপের টাকা ধ্বংস করতে আর ষাঁড়ের মতো গিলতে! আস্ত অপদার্থ একটা!
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এ কথাও বহুবার শুনেছি, কোন ইয়ারে উঠলে? রেজাল্ট কেমন? চাকরির জন্য ট্রাই করছো? বিসিএসের জন্য পড়ছো তো?
এভাবে একদিন বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শেষ হয়। এনজিওতে চাকরি নিই। তারপর থেকে ঘুরেফিরে সেই একই প্রশ্ন :
বেতন কত? এই টাকায় জীবন চলে? এই দিয়ে নিজেই কী খাবে আর সংসারের খরচই-বা কীভাবে জোগাবে? এর পরের রাউন্ডে আসে সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রশ্ন।
বিয়ে করেছ/বিয়ে হয়েছে? কেন? ছ্যাঁকা খেয়েছ নাকি? তোমার বাবা-মা মেয়ে দেখছেন না? পছন্দমতো পাচ্ছেন না? এত খুঁজলে হয়? বেশি বাছলে কিন্তু খারাপটাই জোটে। বিয়ের ক্ষেত্রে সবকিছু সমানভাবে মিলবে না। কিছু ছাড় দিতেই হবে।
এখনো কেন বিয়ে করো না? এখনই তো সময়। দেরি হয়ে যাচ্ছে। বাচ্চাকাচ্চা নিতে হবে তো। আর সবকিছুর তো একটা সময় আছে।
সমস্যা কী? তোমার দিক থেকে মিলছে না, নাকি মেয়েরাই...। অনেক মালদার পাট্টির ধান্ধায় আছ নাকি?
কিছু কিছু বিষয়ে দেখা যায় ব্যক্তি বা পরিবারের মাথাব্যথা নেই কিন্তু চারপাশের মানুষ মাথায় বাড়ি দিয়ে দিয়ে মাথার খুলি উড়িয়ে দেবার অবস্থা করে দেয়। সমাজের এই পেইনের কারণে বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছে, এমন মানুষের সংখ্যা এ যুগে একেবারে কম নয়!
তবে বিয়ে করে ফেললেই আপনার প্রতি পাবলিকের দরদ কমে যাবে তা ভাববেন না। এরপর শুরু হবে : কবে বাচ্চা নিচ্ছ? বাচ্চা নিতে দেরি হলে, ঘনিষ্ঠ হবার ভাব ধরে খুবই সহানুভূতিশীল হয়ে বলবে :সমস্যাটা কার? তোমার? নাকি ভাবির? ডাক্তার দেখাচ্ছ? কাকে?
বাচ্চা হওয়ার পরও শান্তি নেই। শুরু হবে বাচ্চার মনে হয় গ্রোথ কম? ওজন কত? ওমা, ওর ওজন দেখি অনেক কম! এখনো হামাগুড়ি দেওয়া শেখে নাই? দাঁত উঠেছে? না উঠলে, এখনো ওঠে নাই? ডাক্তার দেখিয়েছেন? কথা বলে? বাবা-মা বলে? বলেন কি, এতদিনে তো ছড়া-কবিতা বলার কথা!
এই প্রতিটি প্রশ্নের সঙ্গে থাকবে নিজের বা কোনো আত্মীয়ের শিশুর অভিজ্ঞতা, কত তাড়াতাড়ি সে হামাগুড়ি দিয়েছে, বা তার দাঁত উঠেছে, বা কথা বলছে, গান-কবিতা শিখেছে...।
বাচ্চাকে কোন স্কুলে দিয়েছেন, রোল কত, বাচ্চা একটা হলে বলবে :একটা কেন! আবার দুটো হলে বলবে :একটা নয় কেন? এমন প্রশ্ন চলতেই থাকে।
জীবনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, মানুষ আসলে খুবই দরদি। তারা জানতে চায়, বুঝতে চায়, নিদান দিতে চায়। তাই প্রশ্ন করে এবং প্রশ্নগুলো চলতেই থাকে চলতেই থাকে। আমৃত্যু। সন্তান বড়ো হলে আবারও আসে চাকরিবাকরির প্রশ্ন, এরপর আবার বিয়ে নিয়ে প্রশ্ন। তারপর নাতি-নাতনির প্রশ্ন। এরপর নাতি-নাতনির ঘরে সন্তান নিয়ে প্রশ্ন!
এসব প্রশ্নবাণ থেকে রেহাই পাবার পথ কী? হেসে হেসে জবাব দেবেন? এসব ‘ব্যক্তিগত প্রশ্ন’ না করতে অনুরোধ করবেন? নিশ্চিত, তাতেও রেহাই পাবেন না। তাহলে সমাধান কী? সমাধান একটাই, রগচটা হয়ে যাওয়া, এসব প্রশ্ন শুনলেই উত্তেজিত হয়ে পালটা প্রশ্ন করা। আপনার বাবা কত বছর বয়সে বিয়ে করেছেন, পরকীয়া করেছেন কি না, সেই প্রশ্ন করা। সাহস করে বলা, আপনার মা বিয়ের আগে কয়টা প্রেম করেছেন? অফেন্স ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স। যে আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে একটা প্রশ্ন করবে, আপনি তার ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে দশটা প্রশ্ন করুন। আপনি সফল হবেন। সে ভাগবেই ভাগবে! খুব বেশি হলে আড়ালে-আবডালে আপনাকে বেয়াদব বা ক্রেজি বলবে—এই যা!
n লেখক :রম্যরচয়িতা