শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

র্যাগ ডের বিকৃতি ও অবাধ ভোগবাদ!

আপডেট : ১৬ নভেম্বর ২০১৯, ২২:১১

আমাদের দেশের ভার্সিটিগুলোতে শিক্ষাজীবন শেষে স্টুডেন্টরা র্যাগ ডে বেশ উদ্যমের সঙ্গে উদ্যাপন করে থাকে। সেগুলো মিডিয়া কভারেজও পায়। এছাড়া ইদানীং স্কুল-কলেজগুলোতেও শিক্ষার্থীদের র্যাগ ডে উদ্যাপন করতে দেখা যায়। শিক্ষাজীবন শেষে কিংবা শিক্ষাজীবনের কোনো ধাপ সমাপ্ত করে আনন্দ উদ্যাপনের অধিকার তাদের আছে। সেজন্য তারা মহাসমারোহে র্যাগ ডে পালন করে থাকে। কিন্তু লক্ষণীয় হলো, র্যাগ ডের মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাদের বেশির ভাগই অবগত নয়। ফলে র্যাগ ডের একপ্রকার বিকৃত উদ্যাপন দিনে দিনে প্রকট হয়ে উঠছে। র্যাগ ডে ভিনদেশি তথা ওয়েস্টার্ন কালচার হলেও সেটার একটা মহত্ উদ্দেশ্য রানি ভিক্টোরিয়ার যুগ থেকেই ছিল এবং এখনো আছে। আর তা হচ্ছে :র্যাগ ডেতে আনন্দমিছিল, প্যারেড ও সুস্থ বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্টুডেন্টরা স্বেচ্চাসেবকরূপে ফান্ড তোলে এবং সেই ফান্ড গরিব অভাবীদের মধ্যে দান বা বিতরণ করে। ক্যামব্র্রিজ ডিকশনারিতে র্যাগ ডের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ‘a series of entertaining events and activities organized by college/ university students once a year to collect money for charity.’ অর্থাত্, বিনোদন বা আনন্দমূলক আয়োজনের মাধ্যমে হলেও এর মূল উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীদের দ্বারা চ্যারিট্যাবল ওয়ার্ক বা দানমূলক কাজ।

কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের দেশের স্কুল-কলেজ-ভার্সিটির স্টুডেন্টরা র্যাগ ডেতে নিজেদের অদম্য ভোগবাদী খায়েশই চরিতার্থ করে প্রকারান্তরে। র্যাগ ডেতে তারা নিজেরাই টাকা দেয় আর সেই টাকায় ছেলেমেয়ে একাকার হয়ে উদ্দাম নাচ-গান ও রং মাখামাখির আয়োজন করে অপচয়ের ষোলোকলা পূর্ণ করে। এমনকি তাদের এই বেলেল্লাপনা ও ভোগ-মচ্ছব তারা ভিডিও করে গর্বের সঙ্গে সামাজিক গণমাধ্যমগুলোতেও প্রচার করে! এছাড়া সেই টাকায় টি-শার্ট বানিয়ে নিজেরাই পরে। নিজেরাই তৃপ্তির সঙ্গে পেটপূর্তি করে। অথচ অন্ন ও বস্ত্রের অভাবে পথেঘাটে কত রানারা ধুঁকছে, ঘুরছে! তাহলে তো এখানে র্যাগ ডের মূল উদ্দেশ্য সার্ভ হচ্ছে না। শিক্ষাজীবনের ধাপে ধাপে কিংবা শেষে তারা অবাধ ভোগের শিক্ষা নিয়ে বের হচ্ছে। ত্যাগ ও সমাজসেবার শিক্ষা নিয়ে তো বের হচ্ছে না। এর ফলে ভবিষ্যতে ও কর্মজীবনে ভোগবাদিতাই তাদের মূল শিক্ষা হিসেবে কাজ করবে। এতে সমাজের ও দশের কী লাভ হবে?

যুক্তরাজ্যে র্যাগ ডে পালন করা হয় স্টুডেন্টদের দ্বারা পরিচালিত দাতব্য সংগঠনগুলোর মাধ্যমে। ব্রিটেনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমনকি র্যাগ উইকও পালিত হয়। পুরো রাগ-সপ্তাহ জুড়ে স্টুডেন্টরা ছোটো ছোটো শো, স্টল, এক্সিবিশন, মেলা ও সার্কাসের আয়োজন এবং সুস্থ আনন্দমিছিল বের করে টাকা তোলে গরিবদের দান করার জন্য (with a fundraising campaign for charity)।

উল্লেখ্য, rag বা ragging আর 'rag day' এক জিনিস নয়। প্রথমটা আক্ষরিক। পরেরটা উত্সবকেন্দ্রিক পরিভাষা। অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে rag শব্দের উত্পত্তির ব্যাখ্যায় এর একটা আক্ষরিক অর্থ করা হয়েছে, কর্তৃপক্ষকে উপেক্ষা করে ব্যাপক হইহুল্লোড় ও বিশৃঙ্খল কর্মকাণ্ড করা (an act of ragging; esp. extensive display of noisy, disorderly conduct carried on in defiance of authority)।

আমাদের দেশের ভার্সিটিগুলোতে র্যাগ ডের নামে যা হয়, তা হলো আসলে র্যাগ ডের বিকৃতি। অর্থাত্ অক্সফোর্ড ডিকশনারির rag শব্দের আক্ষরিক ব্যাখ্যারই প্রতিফলন। মূল র্যাগ ডের চ্যারিটির আবেদন ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে সেটার কোনো সম্পর্কই নাই। আমাদের দেশের স্টুডেন্টরা তাদের স্টুডেন্ট লাইফকে স্মরণীয় করে রাখতে এমন বিকৃত ভোগবাদী র্যাগ ডে উদ্যাপন করে থাকে, যা আসলে র্যাগ ডের উদ্দেশ্যেরই পরিপন্থি। তাদের র্যাগ ডের এই বিকৃত ও অসুস্থ উদ্যাপন আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গেও কোনোভাবে মানানসই নয়। বরং এটি আজ নোংরা অপসংস্কৃতিতে রূপ নিয়েছে, যা আমাদের সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধেরও বিরুদ্ধে। র্যাগ ডের নামে হিন্দি-বাংলা গানের তালে তালে একসঙ্গে ছেলেমেয়েদের উদ্দাম নাচানাচি, ঢলাঢলি, রং মাখামাখি আর পেটপূর্তিই এখানকার বাস্তব চিত্র! সবই অপচয়। অনর্থক ভোগবাদী উত্সব। আর এসবের বিপরীতে আমার চোখে ভাসে বস্ত্রহীন ক্ষুধার্ত রানাদের করুণ আকুতির চাহনি।

র্যাগ ডে যদি তারা করতেই চায় তাহলে বলব, আমাদের চিরাচরিত সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সুস্থ বিনোদনমূলক আয়োজনের মাধ্যমে তারা এর মূল উদ্দেশ্য চ্যারিটিতে অবদান রাখুক। শিক্ষাজীবনের ধাপে ধাপে কিংবা শিক্ষাজীবন শেষে তারা ত্যাগ ও দানশীলতার শিক্ষাকেই স্মরণীয় করে রাখুক। আশা করি ছাত্রসমাজ তাদের বিবেককে জাগ্রত করবে। তাদের সচেতনতা কাম্য। আনন্দ-ফুর্তি করলেও তা যেন নিছক আত্মকেন্দ্রিক ও ভোগবাদী মানসিকতার না হয়; বরং হোক বিবেকোচিত এবং সমাজসেবায় সমৃদ্ধ।

n লেখক :শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়