শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

দেশে দেশে অস্থিরতা

আপডেট : ১৭ নভেম্বর ২০১৯, ২১:৩৯

হাসান জাবির

ইতিহাসের সবচেয়ে জটিল ও কঠিন সময় অতিক্রম করছে বিশ্ব। চল্লিশের দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবসান ও তত্পরবর্তীতে স্থির বৈশ্বিক কাঠামো হঠাত্ করেই ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায়। যদিও আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এর সূত্রপাত ঘটে। ফলে বৈশ্বিক অস্থিরতাও নতুন মাত্রা লাভ করে। উল্লিখিত দুই ঘটনায় মারাত্মক সামরিক সংঘাতপ্রবণ হয়ে ওঠে বিশ্ব। এই ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালে আরব বসন্ত আগমনের শুরুতেই আফ্রিকার দেশ লিবিয়ার শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনে সেখানে পশ্চিমা সামরিক আগ্রাসন একটি ভয়ংকর নজির হিসেবে স্থান পায়। এতে করে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে বিশ্ব। এক ধরনের আতঙ্কের মধ্যেই বিস্তার লাভ করে আরব বসন্ত। এই বসন্তের জাঁতাকলে পিষ্ট মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ দেশ সিরিয়া ও ইয়েমেনের সর্বশেষ পরিস্থিতি সবার জন্যই অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

যদিও সাম্প্রতিক কালে মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের দেশে দেশে হঠাত্ করেই গণবিক্ষোভের সূত্রপাত বিভিন্ন পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, হঠাত্ করেই এরকম অস্থিরতার কারণ কী? একই সঙ্গে বিশেষ কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর যুগের বিশ্বকাঠামো ও আন্তর্জাতিক নিয়মকানুনসমূহের ভবিষ্যত্। বিশেষ করে, সাম্প্রতিক কালে বিশ্বের শক্তিধর কয়েকটি দেশ নিজ নিজ স্বার্থে বেশকিছু আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকে সরে এলে এক ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতির সূত্রপাত হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় ইরানের পরমাণু চুক্তির কথা। এরপর রুশ-মার্কিন আইএনএফ চুক্তি, ব্রেক্সিট ও সংশ্লিষ্ট ইস্যুসমূহ।

স্কটল্যান্ডভিত্তিক একটি জরিপ প্রতিষ্ঠান ‘ইপসোর মোরি’। সম্প্রতি এই প্রতিষ্ঠান ব্রিটেনের যুক্তরাজ্য ব্যবস্থা নিয়ে একটি জরিপের ফলাফল প্রকাশ করেছে। যেটি একই সঙ্গে অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও উদ্বেগজনক। উল্লেখ্য, ঐ জরিপে অংশগ্রহণকারী ব্রিটিশ নাগরিকদের মধ্যে ৫০ শতাংশই মনে করেন, আগামী দশক নাগাদ ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, উত্তর আয়ারল্যান্ড ও ওয়েলস নিয়ে গঠিত ইউনাইটেড কিংডম বা ‘রাজকীয় যুক্তরাজ্যে’র কাঠামো ভেঙে পড়তে পারে। এক্ষেত্রে ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন পরিত্যাগসংক্রান্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন-প্রচেষ্টা অভ্যন্তরীণ দ্বিমতের সম্প্রসারণ ঘটায়। উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ব্রেক্সিট-সংক্রান্ত গণভোটে স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইইউতে থাকার পক্ষে ভোট দিয়েছিল। যদিও সামগ্রিক ফলাফলে সিংহভাগ ব্রিটিশের অবস্থান ছিল ব্রেক্সিটের পক্ষে। এই বাস্তবতায় দেশটির স্বাধীনতাকামী অঞ্চলসমূহের চাপা ক্ষোভ বাড়তে থাকে। ফলে সেখানে স্বাধীনতার লক্ষ্যে গণভোটের দাবি জোরালো ইঙ্গিত দিচ্ছে এই জরিপের ফলাফল। যে কারণে ‘ইপসোর মোরি’ জরিপের ফলাফল সবাইকে কিছুটা হলেও চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। যদিও ব্রিটেনের মতো একটি দেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভাঙন জরিপের মতো এতটা সহজ নয়। তবু এটিকে একটি ব্যতিক্রমী ইঙ্গিত হিসেবে না নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

এদিকে ক্রমশ নিস্তেজ হতে থাকা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বপ্ন নতুন করে উজ্জীবিত হয়েছে। মূলত সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের ফলাফল ঐ অঞ্চলে শক্তিসাম্যের যে পরিবর্তন এনেছে এটি তারই প্রতিক্রিয়া। এই পরিপ্রেক্ষিতে ফিলিস্তিনে নতুন নির্বাচনের আওয়াজ তুলেছেন সেখানের দুই শক্তিশালী রাজনৈতিক পক্ষ ফাতাহ ও হামাস। একই সঙ্গে তারা নতুন করে শক্তি সঞ্চয়ের প্রচেষ্টা জোরদার করছে বলে অনুমান করা যাচ্ছে। আবার অতি সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে নতুন করে গণবিক্ষোভ দেখা দিয়েছে। এর জেরে ইরাক, মিশর, কুয়েত ও লেবাননে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে বিক্ষুব্ধ জনতার দাবি মেনে পদত্যাগ করেছেন লেবানন সরকার। সেখানে নতুন সরকার গঠন নিয়ে একধরনের অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে এক বছরের মধ্যে দুটি নির্বাচন করেও স্থিতিশীল সরকার গঠনে ব্যর্থ হয়েছে ইসরায়েল। চলতি বছরের এপ্রিলের পর গত সেপ্টেম্বরে সর্বশেষ নির্বাচনের ফলাফল ইসরায়েলের অচলাবস্থা দূর করতে পারেনি। এর ফলে তেল আবিবেও একধরনের অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। বলা চলে, এরই সুযোগ নিচ্ছে ইসরায়েলবিরোধী আরব দেশগুলো। যে প্রক্রিয়ায় প্রতিরোধকামী শক্তিসমূহ নতুন করে উজ্জীবিত হয়েছে। অন্যদিকে ইরাকের সহিংসতা ও গণবিক্ষোভ নতুন কোনো বিষয় নয়। সেখানে যে কোনো সরকারের পক্ষে বেশি স্বাবলম্বিতা অর্জন বিভিন্ন কারণেই দুরূহ। দীর্ঘ মার্কিন সামরিক উপস্থিতি ছাড়াও প্রতিবেশী শিয়া অধ্যুষিত ইরানের সঙ্গে সম্পর্ককে কেন্দ্র করে বাগদাদের পরিস্থিতি সহজেই স্থিতিশীল হওয়ার নয়। ইতিহাসের এই অনিবার্য বাস্তবতা সবাই নিজেদের মতো করেই উপলব্ধি করে। ঐ ভিত্তিতে সাম্প্রতিক সময়ে বাগদাদ-তেহরান সম্পর্কের উষ্ণতা যেন সামনের দিনগুলোতে আর বেশি জোরদার না হতে পারে সেই নিশ্চয়তা চায় আমেরিকা। এ কারণেই দুদিন আগে ইরাকে নতুন নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে ওয়াশিংটন। অন্যদিকে শক্তি প্রয়োগ করে মিশর ও বাহরাইনের ব্যাপক গণবিক্ষোভ থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যে কোনো মুহূর্তেই আবার বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে পারে এই দুই দেশের জনগণ।

মধ্যপ্রাচ্যের পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশেও। সম্প্রতি চিলিতে সাংবিধানিক সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভ চরম আকার ধারণ করেছে। সেখানে মধ্যডানপন্থি ও ডানপন্থি রাজনৈতিক শক্তিসমূহের নেতৃত্বে বেড়ে ওঠা আন্দোলনে বেকায়দায় পড়েছে সরকার। যদিও বলা হছে অর্থনৈতিক বৈষম্যে, পরিবহনভাড়া বৃদ্ধির কারণেই এই বিক্ষোভ। কিন্তু আসল ব্যাপারটি অনেকটাই ভিন্ন। মূলত চিলিতে সত্তর ও আশির দশকে চলা সামরিক স্বৈরশাসকের কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার এক অশুভ লক্ষ্যে সেখানের পরিস্থিতি চরম উত্তপ্ত। ধারণা করা হচ্ছে, এর ফলাফল হবে সেখানে নতুন নির্বাচন। অন্যদিকে ক’দিন আগেই পদত্যাগ করেছেন বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস। মাত্র কিছুদিন আগেই তিনি নির্বাচনে জেতেন, চতুর্থবারের মতো দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। কিন্তু এই নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে, এমন অভিযোগ এনে বিরোধীরা বিক্ষোভ শুরু করেন। পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আগেই বিরোধীদের দাবি মেনে মোরালেস পদত্যাগ করেন। তবে ধারণা করা হচ্ছে, সেখানে নতুন নির্বাচনেও তিনিই জিতবেন। এদিকে চলতি বছরের শুরুতেই হুবহু বলিভিয়ার মতো ঘটনাই ঘটে ভেনেজুয়েলায়। সেখানে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে জেতেন দেশটির জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো। কিন্তু তার এই দ্বিতীয় জয়ের ফলাফলকে অগ্রাহ্য করে সেখানকার একজন বিরোধী নেতা নিজেকে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করলে পরিস্থিতি চরম উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট গুইদোকে সরাসরি সমর্থন দেয় আমেরিকা, ব্রিটেন ও ইসরায়েল। কিন্তু রাশিয়া ও চীন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মাদুরোর পক্ষে ব্যাপক ভূমিকা রাখায় কারাকাসের বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক। যদিও মার্কিন সমর্থনপুষ্ট কলম্বিয়ার সীমান্তে দেশটির সঙ্গে ভেনেজুয়েলা একপ্রকার যুদ্ধের অবস্থায় আছে। এছাড়াও অস্থিরতা চলছে আরো অনেক দেশেও। সন্ত্রাসকবলিত পাকিস্তানে চলছে সরকারবিরোধী ব্যাপক গণবিক্ষোভ। এদিকে স্পেনের স্বাধীনতাকামী অঞ্চল কাতালান ঘিরে দেশটির পরিস্থিতিও কিছুটা নাজুক। সব মিলিয়ে এসব ঘটনার ফলাফল ও সামগ্রিক প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে এই নিয়ে থাকছে নানা আশঙ্কা।

আমরা এমন একটি বিশ্বে বসবাস করছি, যেখানে প্রতিনিয়ত দানা বাঁধছে নানা ধরনের সংশয়। প্রচলিত-অপ্রচলিত বিভিন্ন ঝুঁকির প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সঙ্গে আছে পরাশক্তিসমূহের মধ্যকার স্বার্থগত দ্বন্দ্বের জেরে যুদ্ধের তোড়জোড়। গত দশকে ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল প্রায় যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। ফলে একটি ভয় মানুষের মধ্যে স্থায়িত্ব পেয়ে আছে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তিসমূহের বরখেলাপ বাড়তি উদ্বেগের কারণ। এর সঙ্গে দেশে দেশে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ আরেক অনিশ্চয়তার ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিশেষ করে, ইরাক ও চিলির পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। ইরাকের সাম্প্রতিক স্থিতিশীলতা ভেঙে পড়লে সেটি আঞ্চলিক পরিসরে মারাত্মক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সঞ্চার করবে। একই সঙ্গে চিলির সাংবিধানিক সংস্কারের দাবি বাস্তবায়ন করলে সেখানকার অস্থিরতা সংকটে রূপান্তরিত হতে পারে। তাই দেশে দেশে এই অস্থিরতার ফলাফল নিয়ে এ ধরনের সংশয়, ভয় থাকছেই।

n লেখক : বিশ্লেষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা