শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ইরান কেন টার্গেট

আপডেট : ১৮ নভেম্বর ২০১৯, ২২:১৪

মো. রাশেদ আহমেদ

যুগ যুগ ধরে বিশ্বরাজনীতি পরিচালিত হয়ে আসছে মধ্যপ্রাচ্যকে কেন্দ্র করে। কেউ-বা আবার এটাকে অস্ত্রের রাজনীতি বা তেলের রাজনীতি বলে থাকে। বর্তমান মধ্য অঞ্চলে সিরিয়া, ইয়েমেন গৃহযুদ্ধ চলছে। এছাড়া যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাকে আজও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আর অন্যান্য রাষ্ট্রে জঙ্গি তত্পরতা লেগেই আছে। বর্তমান ইরানের সঙ্গে আমেরিকা সম্পর্ক দা-কুমড়া। যার পেছনে মার্কিনিদের বড়ো স্বার্থ বিদ্যমান। তবে ট্রাম্প প্রশাসন শত্রুতার পর্যায়কে আকাশচুম্বী করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ইরানের প্রতি আমেরিকার কেন এত ক্ষোভ!

পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলো খুব ভালোভাবে বুঝতে পারছে যে ইরানকে দমিয়ে রাখতে না পারলে মধ্যপ্রাচ্য তেলের রাজনীতি বা অস্ত্র বিক্রির দেশ তৈরি করা যাবে না। সেই সঙ্গে আমেরিকার বন্ধুরাষ্ট্র সৌদি আরব ও মধ্য প্রাচ্যের ক্যানসার নামে পরিচিতি ইসরাইল তাদের নিজস্ব স্বার্থ হাসিল করতে পারবে না। সৌদি আরব ইরানের সিয়া-সুন্নি ধর্মীয় সমস্যা তো গোড়াপত্তনের। আর ফিলিস্তিন ইস্যু নিয়ে ইরান-ইসরাইল ঘোর শত্রুতা বিদ্যমান। যার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের স্বার্থকে প্রধান্য দিতে গিয়ে খোঁড়া অভিযোগের ভিত্তিতে গোটা বিশ্বকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ১৪ জুলাই ২০১৫ ভিয়েনাতে ইরান-ছয় জাতির পরমাণু চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসে ট্রাম্প প্রশাসন, যা দেখে বিস্মিত হয় ইউরোপসহ গোটা বিশ্ব। কিন্তু তাতে আমেরিকার খুব বেশি যায়-আসে না। ইরানের পরমাণু চুক্তি বাতিলের পর আমেরিকা কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। এ অবরোধের মূল কারণ হচ্ছে ইরানকে অর্থনীতিকভাবে পঙ্গু করা। যাতে তারা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বরাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে না পারে। কারণ অর্থনীতি হচ্ছে একটি দেশের মূল চালিকাশক্তি। অর্থনৈতিকভাবে ইরান ভেঙে পড়লে তারা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বরাজনীতিতে আমেরিকার মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে না, এটা তাদের ধারণা। কিন্তু ২০০৬ সাল থেকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ধরনের অবরোধ ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও গত এক দশকে ইরানের সাফল্য ঈর্ষান্বিত। এখন ইরান সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধের মুখোমুখি। কারণ হিসেবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ও ১০ গুণ বৃদ্ধির ঘোষণাকে দায়ী করছে আন্তর্জাতিক মহল। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ। এমনকি ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র রাশিয়াও সতর্কতা অবলম্বন করেছে। বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বরাজনীতিতে ইরানের প্রভাব যথেষ্ট সুবিস্তৃতি লাভ করেছে। রাশিয়া, চীনের মতো দেশের সঙ্গে আগে যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন উষ্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান, যা ইরানের কূটনৈতিক সফলতা বহন করে। এছাড়া সিরিয়া যুদ্ধ নিরসন ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় রাশিয়া, তুরস্কের সঙ্গে একযোগে কাজ করছে ইরান, যা তাদের সামর্থ্যের প্রমাণ মেলে। মানবসূচক উন্নয়নে তাদের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। বর্তমান ১৮৯টি দেশে জরিপে ইরানের অবস্থান ৬০তম। নারীদের অগ্রগতি, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে উন্নয়ন, সুস্থধারার সাংস্কৃতিক চর্চা ও ক্রীড়াঙ্গনে তাদের সাফল্য কম নয়। এছাড়াও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর পারস্য দেশটি, যা বিশ্বে বৃহত্তম তেল উত্পাদনকারী দেশের মধ্যে চতুর্থতম। শুধু তা-ই নয়, বিশ্বের তেল রপ্তানিকারক সংগঠন ওপেকের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য, যে সংগঠনটি বিশ্বের তেল উত্পাদন নিয়ন্ত্রণ করে এবং অপরিশোধিত তেলের মূল্য নির্ধারণ করে। ইরান প্রাকৃতিক গ্যাস মজুতের দিক থেকে দ্বিতীয়। হরমুজ প্রণালির মতো গুরুত্বপূর্ণ জলপথ তাদের কৌশলগত গুরুত্বকে আরো বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে। এ জলপথ দিয়ে পৃথিবীর ৪০ শতাংশ খনিজ তেল পরিবহন করা হয়ে থাকে আর এশিয়ার পারস্য উপসাগরীয় এলাকা থেকে ৮০ শতাংশ খনিজ তেল আমদানি করা হয়।

এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই, বর্তমান ইরানের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ছে। মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে হুহু করে। সেই সঙ্গে বেকারত্বের সমস্যা তো লেগেই আছে। যে হারে বেকারত্ব বাড়ছে সেই হারে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। যার ফলে তাদের সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। তবে এ কথাও ঠিক, ইরানের আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, আমেরিকার সঙ্গে চরম শত্রুতা ও বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তাদের জাতীয় মনোবলকে ভেঙে ফেলা যাবে না। বরং তাদের জাতীয় ঐক্যকে আরো বেশি দৃঢ় করবে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, অপ্রতিরোধ্য ইরানিদের আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, অবরোধ দিয়ে দমিয়ে রাখা সম্ভব নয়। সময়ের পরিক্রমায় ফল হতে পারে উলটো। তাই সময় থাকতে সব পক্ষেরই আলোচনার টেবিলে বসা উচিত। সুতরাং আগামী দিনে আলোচনার টেবিল হতে পারে ইরান সংকট নিরসনে বড়ো উপহার।

n লেখক :শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া