শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

চীন-আমেরিকা বাণিজ্য লড়াইয়ের শেষ কোথায়

আপডেট : ০৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ২১:৫২

অতীতে হাতিয়ার তথা সামরিক শক্তিই ছিল সুপার পাওয়ার হওয়ার একমাত্র উপায়। যখন যে জাতির হাতে অপেক্ষাকৃত আধুনিক সমর ব্যবস্থা ছিল, তখন সেই জাতি অন্যদের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। মোঙ্গলদের কাছে ছিল শক্তিশালী, বিশালাকার তাজা ঘোড়া এবং লম্বা তলোয়ার। তাই চেঙ্গিস খান, হালাকু খানরা যতদূর চোখ যায় ততদূর দখল করে ধ্বংসলীলায় মেতে উঠতে পেরেছেন। অটোমানরা প্রাথমিক পর্যায়ের গাদা বন্দুক, কামান এবং মধ্য এশিয়ার ঘোড়ার সুবাদে বিশাল রাজ্য তৈরি করেছিল। তখনকার সুপার পাওয়ার বা পরাশক্তি বলা যায়। ব্রিটিশরা বন্দুকের আধুনিক সংস্করণ এবং শক্তিশালী জাহাজের দ্বারা বিশ্বের সর্বকালের সবচেয়ে বড়ো সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। ব্রিটেন ছিল পরবর্তীকালে একমাত্র সুপার পাওয়ার। ততদিনে সমরাস্ত্র আধুনিক হয়েছে, আকাশে উঠেছে যুদ্ধবিমান। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আবির্ভাব হয় পরাশক্তি হিসেবে। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন উঠে এলেও পরে অর্থনৈতিক কারণে পিছিয়ে পড়ে, যার পরিণতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নই ভেঙে যায়। তখন থেকেই বোঝা যায়, কেবল অস্ত্র নয়, অর্থনীতিতে শক্তিশালী না হতে পারলে কেউ আর পরাশক্তি হিসেবে টিকে থাকতে পারবে না। শুরু হয় অস্ত্রের পাশাপাশি অর্থনীতিকে নানা কৌশলে চাঙ্গা করার প্রতিযোগিতা।

এই প্রতিযোগিতায় অবশেষে নিঃশব্দে এগিয়ে এসেছে চীন। আর এখন বিশ্বের সামনে উপস্থিত হয়েছে এক ভিন্ন মাত্রার যুদ্ধ। এ যুদ্ধ এমন আকার ধারণ করেছে, যাকে বিস্ফোরণোন্মুখ বললে অত্যুক্তি হবে না।

যুক্তরাষ্ট্র এই পরিস্থিতি নিয়ে কী ভাবছে? আমেরিকার জন্য চীন কতটা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে? সংবাদমাধ্যমের এমন প্রশ্নের জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রবার্ট স্পাল্ডিং বলেছেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাজি পার্টির পর আর এমন হুমকি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আসেনি। সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের জন্য যতটা হুমকি ছিল, তার চেয়েও চীন অনেক অনেক বড়ো হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

কী করে চীন এত বড়ো মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াল, সে পরিস্থিতি বুঝতে একটু পেছনে ফিরে তাকাতে হয়। ২০০০ সালে চীন ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন বা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যোগ দেয়। তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ডেমোক্র্যাট দলের বিল ক্লিনটন। ক্লিনটন সে সময় আশা প্রকাশ করেছিলেন, ‘চীনের এই সংস্থায় যোগদানের মানে হলো বিশ্বের এক-পঞ্চমাংশ মানুষের এই দেশটির বাজার আমাদের জন্য খুলে যাবে। চীন-ই বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো বাজার। আমাদের কোম্পানিগুলো আমেরিকার শ্রমিকদের উত্পন্ন পণ্য চীনের বাজারে বিক্রি করবে চীন সরকারের মাধ্যমে। প্রথমবারের মতো মূল্যবান প্রযুক্তি স্থানান্তিরত হবে। চাকরি রপ্তানি না করে আমরা উত্পাদিত পণ্য রপ্তানি করতে পারব।’

চীন সুযোগটি লুফে নিয়েছিল। মনে কী ছিল কে জানে! ২০০৫ সালে চীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানির ক্ষেত্রে গড়পড়তা ট্যারিফ ৪০ শতাংশ থেকে নামিয়ে ১০ শতাংশে নিয়ে আসে। ২০০৫ সালেই দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনের রপ্তানি বেড়েছে ৩১ শতাংশ, অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বেড়েছে ১৬ শতাংশ! এবার যুক্তরাষ্ট্রের মেজাজ খারাপ হতে শুরু করে।

২০০০ সালে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৯০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। কিন্তু ২০১৭ সালে এসে দেখা যায়, সেই বাণিজ্য ঘাটতি ৬০০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে! এই ১৭ বছরের মধ্যে নানা ঘটনা ঘটে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে অভিযোগ উঠেছে চীন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার শর্তগুলো মানছে না। ২০০৮ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাটি চীনের বিরুদ্ধে কিছু রুলিং জারি করে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অভিযোগ ওঠে, চীন ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি চুরি করছে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বহু কোম্পানি স্বল্প মজুরির কারণে তাদের কোম্পানি তুলে নিয়ে চীনে প্রতিষ্ঠা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতে, এর ফল হয়েছে আরো উলটো। চীন সরকার সুকৌশলে কোম্পানিগুলোকে বাধ্য করেছে তাদের পেটেন্ট-ফরমুলা চীনের হাতে তুলে দিতে। তাছাড়া চীন নাকি বহু প্রযুক্তি চুরিও করে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, চীন ২০১৭ সাল পর্যন্ত মাত্র চার বছরে ৯৩৬ বিলিয়ন ডলারের ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি চুরি করেছে! কোনো কোনোটি বিভিন্ন দেশে বিক্রিও করে দিয়েছে।

অবশেষে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মরণ কামড় দিলেন। তিনি ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে চীনা পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ ট্যারিফ বসালেন। চীনও পালটা ব্যবস্থা গ্রহণ করল। তাতেও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ফল হলো উলটো। ট্যারিফ আরোপ পরবর্তী এক বছরে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রপ্তানি কমেছে ১৩ শতাংশ, পক্ষান্তরে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি কমেছে ১৫ শতাংশ। সার্বিক রপ্তানিতে এ পর্যন্ত দেখা গেছে চীনের জিডিপিতে এর প্রভাব পড়েছে ০.০৩ শতাংশ, আর যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপিতে ০.২৫ শতাংশ।

যুক্তরাষ্ট্র চীনে অন্যতম বড়ো রপ্তানি করে থাকে সয়াবিন। এই সয়াবিন চীনে শূকরের খাবার হিসেবে ফার্মগুলোয় ব্যবহূত হয়। ইতিমধ্যে চীনে সোয়াইন ফিবার নামে একটি মহামারি রোগ দেখা দেয় শূকরের শরীরে। চীন সেই সুবাদে লাখ লাখ শূকর মেরে ফেলে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সয়াবিনের রপ্তানি কমে যায়। এ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র প্লেন, হেলিকপ্টার, পরিশোধিত পেট্রোলসহ ৩০টি পণ্য চীনে রপ্তানি করে। আর চীন কম্পিউটার, অফিস মেশিন পার্টস, গাড়ির খুচরা যন্ত্রাংশ, টেলিফোন, সোয়েটার, জুতাসহ ৩০টি পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে মেক্সিকো এবং জার্মানিতে রপ্তানি। চোখে পড়ার মতো রপ্তানি কমেছে এই দেশ দুটোতে।

আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে যখন এমন চোরা মার খেতে হচ্ছে, তখন ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও চীনের প্রভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের অধীন চায়না পাওয়ার প্রজেক্টের পরিচালক বনি গ্ল্যাসার সম্প্রতি বলেছেন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মুখ এখন ঘুরে গেছে। সন্ত্রাস এখন আর যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড়ো হুমকি নয়। এখন বড়ো হুমকি হলো বড়ো দুই শক্তির (যুক্তরাষ্ট্র-চীন) প্রতিযোগিতা।

দক্ষিণ চীন সাগরে চীন যে কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করেছে এবং সেনাবাহিনীর নজরদারিতে রেখেছে, ঐ অঞ্চল দিয়ে প্রতি বছর ৫.৩ ট্রিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য যাতায়াত করে। জায়গাটি বাণিজ্য চলাচলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রুট। এই দ্বীপটি গড়ে তোলার সময় যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে যুদ্ধ বাধার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু চীন এত দ্রুত তার সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেছে  যে, এখন আর ওই স্থানে এসে চীনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানোর কথা যুক্তরাষ্ট্র ভাবছে না। 

চীন দ্রুত আকাশশক্তি বৃদ্ধিতে মনোযোগ দিয়েছে। একের পর এক জে সিরিজের যুদ্ধবিমানের সংস্করণ করে চলেছে। জে-১৫, জে-১৬, জে-২০-র পর এখন স্টিলথ জে-৩১ সংস্কারে ব্যস্ত। ইন্টারনেটে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ভারসাম্যের যে হিসাবে রয়েছে, তাতে দেখা যায়, সব মিলিয়ে ‘কেহ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান’ অবস্থা দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে শ্রীলঙ্কা থেকে শুরু করে জিবুতি পর্যন্ত চীনের নজর বিস্তৃত হয়েছে। গত দুই দশকে আফ্রিকার বহু দেশে চীন ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। সর্বোপরি চীনের বাজার বিস্তৃত হয়েছে ইউরোপ থেকে দক্ষিণ আমেরিকা সর্বত্র।

এমন অবস্থায় শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিকভাবে চীনকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য দুটি হাতিয়ার এই মুহূর্তে ব্যবহার করতে চেষ্টা করছে। একটি হলো হংকং, আরেকটি উইঘুর প্রদেশের মুসলমান সম্প্রদায়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সম্প্রতি হংকং পলিসির সংস্কার করেছেন এবং হংকং পুলিশের বিশেষ সরঞ্জাম সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়েছে চীন; জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারি জাহাজ ও বিমান হংকংয়ে বিরতি নিতে পারবে না বলে ঘোষণা করেছে। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থাকে নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে। 

এখন পশ্চিমা বিশ্ব বলছে, চীনের উইঘুরে হাজার হাজার মুসলমানকে হত্যা ও বন্দিশিবিরে নিয়ে আটকে রেখেছে চীন। তাদের ওপর নানা নির্যাতনের গল্প শোনা যাচ্ছে। এরই মধ্যে একটি বন্দিশালায় হাজার হাজার বন্দির একটি ডকুমেন্ট লিক হয়েছে বলেও পশ্চিমা গণমাধ্যম দাবি জানিয়ে আসছে। একটি ভিডিও ঘুরে বেড়াচ্ছে ইন্টারনেটে।  কিন্তু বিবিসির স্টিফেন সাকারকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে লন্ডনে নিযুক্ত চাইনিজ রাষ্ট্রদূত লিউ জিয়াওমিং বলেছেন, ‘এটি সম্পূর্ণ বানোয়াট একটি লিক। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছি, এমন ডকুমেন্ট কেউ দেখাতে পারবে না।’ ৩ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র কয়েকজন চীনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।

এই দুটি দেশের মধ্যে পরাশক্তি হওয়ার লড়াই এখন তুঙ্গে। চীন এখন পর্যন্ত অর্থে এবং সামরিক শক্তিতে সামান্য পিছিয়ে থাকলেও মাত্র দু-চার বছরের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রকে অতিক্রম করবে। বহু পক্ষ থেকে তা-ই বলা হচ্ছে। মনে হচ্ছে কথাটি অমূলক নয়। এছাড়া কয়েকটি বাড়তি সুবিধা চীনের আছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেশে-বিদেশে হঠকারী বলে বদনাম আছে। তিনি অস্থির প্রকৃতির এবং হুটহাট সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু চীনের প্রেসিডেন্ট অত্যন্ত ঠান্ডা মাথা এবং গভীর মেধার মানুষ। প্রতিবেশী রাশিয়ার সঙ্গে তার কোনো ঝামেলা নেই। বরং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বড়ো সংঘাতে রাশিয়ার সহযোগিতা পাবেন তিনি। সেটা আরেক কাহিনী। 

n লেখক :সাংবাদিক সাহিত্যিক