বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

রোকেয়ার নারীচিন্তা

আপডেট : ০৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ২১:৪৩

নূর কামরুন নাহার

উনবিংশ শতাব্দীর পশ্চাত্পদ সমাজে জন্ম নেওয়া রোকেয়ার দর্শনে ছিল আধুনিকতা। উন্নত সমাজ গঠনে প্রয়োজন শিক্ষা এবং এই শিক্ষা শুধু পুরুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেই চলবে না, সমৃদ্ধ সমাজ ও জাতি গঠনে শিক্ষিত পুরুষের পাশাপাশি শিক্ষিত ও বোধসম্পন্ন নারীও প্রয়োজন এ ধ্রুব সত্য রোকেয়ার দূরদৃষ্টিতে খুব ভালোভাবেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।  বেগম রোকেয়া আধুনিক ও অগ্রসর সমাজ গঠনের লক্ষ্যে প্রথমেই নারীশিক্ষার কথা বলেছেন। রোকেয়া যথার্থভাবে চিহ্নিত করেছিলেন অশিক্ষা ও অবরুদ্ধ জীবন নারীর চিন্তাশক্তিকে পঙ্গু করে ফেলেছে। নারী হারিয়ে ফেলেছে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা, ফলে তার দেহ ও মন চালিত হচ্ছে অন্যের ইচ্ছায়। এভাবে নিজের চিন্তা ও ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগানোর সুযোগ না থাকায় নারীর দেহ ও মন অন্যের দাস হয়ে পড়েছে। আর দুর্ভাগ্যের বিষয়, নারী এই দাসত্বকেই নিজের জীবনের সৌভাগ্য মনে করছে। এই দাসত্ব, মনের এই বৈকল্য থেকে নারীকে জাগানোর জন্য রোকেয়া আমাদের চিন্তার জায়গাটিতে আঘাত করেছেন, রোকেয়ার তীর্যক  প্রশ্ন—

‘এই বিংশ শতাব্দীর সভ্য জগতে আমরা কি? দাসী। পৃথিবী হইতে দাস ব্যবসায় উঠিয়া গিয়াছে শুনি কিন্তু আমাদের দাসত্ব গিয়াছে কি? না। আমরা দাসী কেন?’

আমাদের মন পর্যন্ত দাস  হইয়া গেছে।

রোকেয়া চেয়েছিলেন দাসত্বের মুক্তি। এই দাসত্বের মুক্তি শুধু নারীর অবরোধবাসিনী জীবন বা নারীর পরনির্ভরশীল জীবন থেকে মুক্তি নয়, নারীর বিকল মন ও চিন্তার বৈকল্য থেকে মুক্তি। অশিক্ষার অন্ধকার আর আত্মার পরাধীনতা থেকে মুক্তি। এই মুক্তির আলো তিনি দেখেছিলেন শিক্ষায়। রোকেয়ার সেই শিক্ষার  অর্থ ব্যাপক ও প্রয়োগিক—

‘শিক্ষা’র অর্থ কোন সম্প্র্রদায় বা জাতি বিশেষের ‘অন্ধ-অনুকরণ’ নহে। ঈশ্বর যে স্বাভাবিক জ্ঞান বা ক্ষমতা  দিয়েছেন, সেই ক্ষমতাকে অনুশীলন দ্বারা বৃদ্ধি  করাই শিক্ষা। .... যদি আমরা অনুশীলন দ্বারা হস্তপদ সবল করি, কর্ণ দ্বারা মনোযোগ পূর্বক শ্রবণ করি এবং চিন্তাশক্তি দ্বারা আরও সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করিতে শিখি—তাহাই প্রকৃত শিক্ষা’

প্রকৃত শিক্ষায় আলোকিত নারীকে রোকেয়া চেয়েছেন পরনির্ভরশীলতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে। কারণ পরনির্ভরশীল মানুষ পরিবার এবং সমাজের গলগ্রহ ও বোঝা।  পরনির্ভরশীলতা যেমন মানুষের অধোগতির কারণ তেমনি  তা মনের স্থবিরতারও অন্যতম কারণ। নিজ সত্তার জাগরণের জন্য কর্ম করা প্রয়োজন, প্রয়োজন যোগ্যতা ও প্রতিভার বিনিয়োগীকরণ এবং স্বাধীনভাবে জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থাকরণ। রোকেয়ার স্বপ্নের নারী ছিল অবরুদ্ধতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত ও প্রকৃত শিক্ষায় আলোকিত স্বাধীন উপার্জনক্ষম নারী।

‘আমরা লেডি কেরানি হইতে আরম্ভ করিয়া লেডি ম্যাজিস্ট্রেট, লেডি ব্যারিস্টার, লেডি জজ সবই হইব।’

রোকেয়া চেয়েছিলেন তার সমাজের কুসংস্কার আর অন্ধকার দূর করতে। আর সেজন্যই চেয়েছিলেন নারীর উন্নয়ন এবং স্বশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত নারী। সুশিক্ষিত উপার্জনক্ষম নারী আর কিছুই নয় সমাজের ও দেশের সম্পদ। নারী পুরুষের মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া সমাজ যে কখনো উন্নতি লাভ করতে পারে না, রোকেয়া তা খুব ভালোভাবেই বুঝেছিলেন। ১৯৫০ সালে কলম্বো পরিকল্পনা উত্থাপিত হলে সারাবিশ্ব কাতর হয়ে পড়ে আধুনিকায়নের জ্বরে। উন্নয়নের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে উন্নয়নশীল বিশ্ব আর  কাঙ্ক্ষিত সে উন্নয়নের জন্য নারীর ক্ষমতায়ন হয়ে পড়ে অপরিহার্য। বিশ্বে তোলপাড় শুরু হলো নারী ইস্যুতে, বাঘা বাঘা নীতিনির্ধারকরা গলধঘর্ম হয়ে যান উন্নয়ন আর নারী ক্ষমতায়ন নিয়ে। বলা হয়, উন্নয়নের মূল সে াতে নারীকে সম্পৃত্ত করা না গেলে কখনই উন্নয়ন সম্ভব নয়।

রোকেয়ার নারীচিন্তা আর সমাজচিন্তা মূলত একই মুদ্রার দুটি পিঠ, পাশাপাশি সমান্তরালভাবে বহমান। তার নারী উন্নয়ন চিন্তা পক্ষান্তরে সমাজ আর জাতিরই উন্নয়ন চিন্তা। উন্নয়নের এই বিন্দুতে রোকেয়ার মধ্যে নারী-পুরুষের কোনো বিভেদ ছিল না, সেখানে স্বার্থ ছিল একটাই এই সমাজের উন্নয়ন, এই বাঙালি জাতির উন্নয়ন। আর এজন্যই রোকেয়া নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করেছিলেন সার্বজনীন সেই শাশ্বত সত্য—

পুরুষের স্বার্থ আর আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে—একই। তাঁহাদের জীবনের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য যাহা আমাদের লক্ষ্যও তাহাই। শিশুর জন্য পিতামাতা উভয়েরই সমান দরকার।

n লেখক :কথাশিল্পী