শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

মুক্তিযুদ্ধ ও একজন জয়ন্তীবালা দেবী

আপডেট : ১১ ডিসেম্বর ২০১৯, ২১:০৯

জয়িতা শিল্পী

মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে শত শত বীরাঙ্গনা যারা নিজের পরিবারের কাছে ফিরতে পারেননি, বঙ্গবন্ধু তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছেন, বেঁচে থাকার সাহস জুগিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই আবেগ দ্বারা তাড়িত হয়ে ২০১৫ সালে এসব বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধা খেতাবে ভূষিত করেছেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এই প্রাপ্তি তাদের কাছে পরম তৃপ্তির, যা তাদের বক্তব্যের মধ্যেই ফুটে ওঠে।

ময়মনসিংহ জেলায় বীরমাতা বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা শতাধিক। কিন্তু এ পর্যন্ত মাত্র ১৩ জনকে গেজেটভুক্ত করা সম্ভব হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ সম্মান ফিরিয়ে দিতেই এই মহান উদ্যোগ। তাই যেসব বীরঙ্গনা এখনো গেজেটভুক্ত হননি, কর্তৃপক্ষ যাচাই-বাছাই করে দ্রুত তাদেরকে গেজেটভুক্ত করবেন—এটাই প্রত্যাশা। এরইমধ্যে অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন, যাদের সঠিক তথ্য খুঁজে বের করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। তাই সময় থাকতে এই কাজগুলো সম্পন্ন করা প্রয়োজন।

বীরাঙ্গনা নারীদের বীর মুক্তিযোদ্ধা খেতাবে ভূষিত করার সময় প্রতিবেদনে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধকালে নির্যাতিত নারীর প্রকৃত হিসাব কারো কাছে নেই। বলা হয়ে থাকে, মুক্তিযুদ্ধকালে ২ লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছেন। অপূর্ব শর্মার ‘বীরাঙ্গনা কথা’ বইয়ের ভূমিকায় বলা হয়েছে, ‘মুক্তিযুদ্ধে আমাদের দুই লাখ মা-বোন ইজ্জত হারিয়েছেন—এমন তথ্য প্রচলিত থাকলেও নির্যাতিত নারীদের সংখ্যা এর দ্বিগুণ হতে পারে।’ ডা. এম এ হাসান পরিচালিত ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির তথ্য অনুযায়ী, ১ লাখ ৬২ হাজার নারী ধর্ষণের শিকার এবং আরো ১ লাখ ৩১ হাজার হিন্দু নারী উধাও হয়ে গিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে কিছু বীরাঙ্গনার নামের তালিকা সংরক্ষিত আছে, কিন্তু সেটি পূর্ণাঙ্গ নয়। উক্ত তালিকা যাচাইবাছাই করে ৮০ জনকে প্রাথমিক পর্যায়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা খেতাবে ভূষিত করা হয়েছে। এই কাজ এখনো চলমান রয়েছে।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নারী পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় শত শত বীরাঙ্গনা আশ্রয় নেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে  সপরিবারে হত্যা করা হলে পরবর্তী সময়ে বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসন কর্মসূচি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর রাষ্ট্রীয়ভাবে কখনো সাহায্য-সহযোগিতা ও পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কখনো কখনো পত্রিকায় কোনো সংবাদ ছাপা হলেও তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। আবার সময় ফুরিয়ে গেলে এ নিয়ে কেউ কোনো কথা বলে না। এসব বিভিন্ন কারণে বীরাঙ্গনাদের মর্যাদা ও ভরণ-পোষণের আশানুরূপ ব্যবস্থা এখনো পর্যন্ত করা যায়নি।

বীরাঙ্গনা জয়ন্তীবালা দেবীর জন্ম ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া থানায়। ১৯৬৬ সালে পার্শ্ববর্তী ভালুকা উপজেলার গোঙ্গারী গ্রামের উমেশ চন্দ্র দেবনাথের ছেলে নিতাই চন্দ্র দেবনাথের সঙ্গে জয়ন্তীবালা দেবীর বিয়ে হয়। তখন তার বয়স ছিল ১৬ বছর। বিয়ের অল্প দিনের মধ্যেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে শহিদ হন নিতাই চন্দ্র দেবনাথ। পরে দুই মাস জয়ন্তীবালা দেবীকে ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়। জয়ন্তীবালা দেবী দীর্ঘ অপেক্ষার পর স্বীকৃতি পেলেও তার স্বামীর কোনো স্বীকৃতি মেলেনি। জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জয়ন্তীবালা দেবীকে একটি স্বীকৃতিপত্রসহ ২ হাজার টাকা পাঠিয়েছিলেন, যে স্মৃতি জয়ন্তীবালা দেবী এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন।

স্বাধীনতার পর ৪৮ বছর ধরে বিধবা হিসেবে বসবাস করছেন জয়ন্তীবালা দেবী। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বেয়নেটের আঘাতে শহিদ স্বামীর স্মৃতি বুকে নিয়ে এবং পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে দুই মাস নিজে আটকে থাকার দুঃসহ স্মৃতি বুকে নিয়ে বেঁচে আছেন জয়ন্তীবালা, যে কথা কাউকে বলতে চান না তিনি। দেশের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করা এই বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় পরম আনন্দ অনুভব করছেন। তবে কোনো ভাতা না পাওয়ায় এখনো ছুটে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন দপ্তরে।

বিভিন্ন সামাজিক ও আন্তর্জাতিক গবেষকগণ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং ধর্ষণকে যুদ্ধের একটি কৌশল হিসেবে দেখিয়েছেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান পরিকল্পিতভাবে সেই কৌশল গ্রহণ করেছে। তত্কালীন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার তথ্য থেকে এ বিষয়ে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। বাঙালি নিরীহ জনগণকে বিপর্যস্ত ও দুর্বল করে দিতে পাকিস্তান আর্মি সাধারণ বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং মানসিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে অসহায় নারীদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার ও নির্যাতন চালায়। তাদের অত্যাচার থেকে রেহাই পায়নি বৃদ্ধ মাতা বা অবুঝ শিশু। যুদ্ধের নয় মাস শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয় বাঙালি নারী ও যুবতী মেয়েরা। দুঃখজনক হলেও সত্য, এখনো তাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা করা সম্ভব হয়নি। তাদের স্বীকৃতি ও সহায়তা আশানুরূপভাবে করা সম্ভব হয়নি। যতটা কার্যকর পদক্ষেপ এ বিষয়ে গ্রহণের প্রয়োজন ছিল, আমরা ততখানি করতে পারিনি। ময়মনসিংহ জেলায় যে কয়েকজন বীরাঙ্গনা বেঁচে আছেন, তাদের বেশির ভাগই অবহেলায়, অযত্নে ও অভাব-অনটনে দিন কাটাচ্ছেন। দু-একজন সমাজে প্রতিষ্ঠিত হলেও অন্যরা কেউই প্রকাশ্যে তাদের বীরাঙ্গনা পরিচয় দিতে চান না। এই পরিচয় দিতে তারা কুণ্ঠা বোধ করেন। আমাদের সবার দায় তাদের এই দৈন্যতা থেকে মুক্ত করে মর্যাদাপূর্ণ জীবন দান করা। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানার্থে এটি করা প্রয়োজন। বাঙালি জাতির পক্ষে এই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ঋণ কোনো দিন শোধ করা সম্ভব নয়। তাদের প্রতি যথাযথ কর্তব্য পালনই আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। বিজয়ের মাসে সব বীরাঙ্গনাকে  জানাই  স্যালুট ও বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

n লেখক : অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন)