বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

প্রণব মুখার্জির জন্মদিন পালিত হলো

আপডেট : ১১ ডিসেম্বর ২০১৯, ২১:১০

আরশিনগর g বাহার উদ্দিন

সংশয়হীন, কিন্তুহীন চিন্তা আর মননের স্বচ্ছতায়, প্রণববাবু, শ্রীযুক্ত প্রণব মুখ্যোপাধ্যায় আমাদের অন্যতম অবলম্বন। তার তর্কনির্ভর সিদ্ধান্তময়তা, তার জাগ্রত ভাবনা, যা সমাজতত্ত্ব আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিশ ও একুশ শতকের শেষেও আরম্ভকে, সমৃদ্ধ করেছে, এখনো যে রকম দ্যুতি ছড়াচ্ছে সামাজিকতার নানা অঙ্গনে, তার নিদর্শন এই উপমহাদেশে, এই মুহূর্তে চোখে পড়ছে না।

বয়স আর বার্ধক্য কারো কাছে তুচ্ছ, কারো কাছে হয়তো বা বোঝা হয়ে ওঠে। প্রণববাবুর ক্ষেত্রে বয়সের সৌন্দর্য আর পূর্ণতার ধারাবাহিক উত্তরণ এক অপার বিস্ময়। বিশেষায়িত এই ব্যাখ্যার শুরুতেই আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে, অনেকেই কিন্তু কিন্তুর গুঞ্জন তুলে বলতে পারেন, জীবদ্দশায় প্রতিভার মূল্যায়ন ঠিক নয়—দূরে দাঁড়িয়ে ব্যক্তিকে, ব্যক্তির কর্মকাণ্ডকে দেখতে হয়, এটাই নিরপেক্ষ ইতিহাসের নির্দেশ। এ নির্দেশকে মেনে নিয়েই স্মরণ করিয়ে দেওয়া জরুরি যে, বহমান সময় আর ঘটনা নিয়ে ব্যক্তি অথবা সমষ্টির প্রতিক্রিয়াকে আধুনিক দর্শন গভীর দৃষ্টিতে খতিয়ে দেখে। তার তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন বার্টান্ড রাসেল। ইতিহাস চর্চার আধুনিকতম অভিমুখ যখন অতীতকে স্পর্শ করে সমসাময়িকতায় তার রসদ খোঁজে, সংকেত দেয় অনাগত ভবিষ্যতের, তখন তাত্ক্ষণিকতার অভিব্যক্তি সামনে চলে আসে। এ কথা প্রকারান্তরে বলেছেন যেমন টয়েনবি, ঠিক তেমনি সমাজতত্ত্বের জনক ইবনে খালদুনও জানিয়ে গেছেন, ত্রিকালকে জড়িয়েই মুখ ঘোরায় ইতিহাস। আর এখানে ব্যক্তি প্রতিভা (ইনডিভিজুয়াল ট্যালেন্ট) সমাজ ও সময়ের ভাষ্যকার হয়ে ওঠে।

প্রণববাবুর ৫০ বছরের ব্যবহারিক রাজনীতি, রাজনীতির পাশাপাশি ভারতীয় দর্শন, ভারতীয় রাষ্ট্রচিন্তা, আর ভারতীয় গণতন্ত্রের অধ্যয়নে তার যে মুখ আমরা দেখি, সেখানে অভিজ্ঞতা, সময়, ভবিষ্যতের স্বপ্ন ও দিকদর্শন মুখ্য হয়ে ওঠে। সক্রিয় রাজনীতিতে কংগ্রেসের সংগঠক, মন্ত্রী, দলনেতা কিংবা জোট রাজনীতির প্রবক্তা হিসেবে সংসদে, সংসদের বাইরে তার উজ্জ্বল ভূমিকার সঙ্গে ভারতের ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতির অবস্থানের দূরত্ব অবশ্যই আছে। কিন্তু কৌশলপ্রিয় রাজনৈতিক প্রণববাবু যে সহিষ্ণুতা, যে নিরপেক্ষতা পাঁচ দশক জুড়ে নিজের ভেতরে ও বাইরে লালন করেছেন, সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতিটি শর্তকে মান্যতা দিয়েছেন, রাষ্ট্রপতির ভূমিকায় তার বহুমাত্রিক প্রজ্ঞার বিকশিত আলো মননের ধারাবাহিকতাকে অধিকতর উঁচু করেছে। মনে রাখতে হবে, কংগ্রেস আমলে, কংগ্রেসের জয়ী প্রার্থী হিসেবেই রাষ্ট্রপতিভবনে তার প্রবেশ। কিছুদিন পরেই দিল্লিতে বদলের পরেও নতুন সরকারের সঙ্গে কখনো সংঘাত তৈরি হয়নি তার। কিন্তু বিদ্বেষের হা-মুখ চওড়া হলেই রাষ্ট্রকে, সমাজকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, হিংসা নয়, ঘৃণা নয়, অহিংসা সৌহার্দ্য আর বহুত্ববাদেই ভারতের শাশ্বত ঐতিহ্য। এটাই তার গণতান্ত্রিকতার পরম ধর্ম। দ্বিতীয়ত, প্রশ্নময়তা যখনই সংকটের সম্মুখীন হয়েছে, তখন প্রতিটি সামাজিক মঞ্চে প্রশ্ন, যুক্তি আর বিবেকের পরম্পরা তার ভাষণ আর বয়ানের সারাংশ হয়ে ওঠে। এসব ব্যাপারে সরকারের নীতি আর প্রীতি যা-ই হোক না কেন, ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতি তার আদর্শ, তার স্বচর্চিত জীবনবোধ থেকে কোথাও সরে দাঁড়াননি।

প্রতিষ্ঠানের হয়েও প্রাতিষ্ঠানিকতার বিচ্যুতিকে রেহাই দেননি। জিজ্ঞাসা, বিতর্ক, আলোচনা (ডিসকোর্স) আর ইতিবাচক সিদ্ধান্ত—যা দর্শনচর্চায় ভারতের সেরা উপহার, তার ওপর ভরসা রাখার পরামর্শ দিয়ে কখনো বলেছেন, কখনো লিখেছেন যে, ঐতিহ্যের এই উত্তরাধিকারকেই জড়িয়ে থাকতে হবে। এই পথেই অনেকটা পোক্ত গণতন্ত্রের সমৃদ্ধি বাড়বে।

১১ ডিসেম্বর, ৮৪-তে পা দিয়েছেন প্রাজ্ঞ ভারততাত্ত্বিক। যাকে রাষ্ট্রদ্রষ্টা, স্বপ্নদ্রষ্টা বলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। জন্মদিনের শুরুতেই নিয়মিত কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত। ১০ ডিসেম্বর, সকালে বিশ্বভারতীর আয়োজিত সভায় ‘গণতন্ত্রের প্রাসঙ্গিকতা’ নিয়ে বললেন, ভিড় ঠাসা সভায়। বিকালে, তার প্রয়াত দাদা অধ্যাপক পীযূষ মুখার্জির স্মারক বক্তৃতা। গণতন্ত্রের কথা বলতে বলতে বারবার ছুঁয়ে গেলেন দর্শন, ইতিহাস আর রাষ্ট্রবিজ্ঞান। বললেন, ভারতে সংসদীয় গণতন্ত্র আজ অনেকটাই পোক্ত। যে কোনো ধাক্কা সে সামলাতে পারে। যুক্তি আর জিজ্ঞাসা ছড়িয়ে থাকে প্রণববাবুর ভাষণে। যুক্তির ভেতর দিয়ে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে যান সিদ্ধান্তে। যেখানে কিন্তু, সংশয়ের  ছায়া নেই। চিন্তার পরিচ্ছন্নতায় ভরাট  তার সামগ্রিক ভাবনা যা বয়স, অভিজ্ঞতা আর নিয়মিত অধ্যয়নে ঋদ্ধ। পরিণত।  তার বয়সকে উপেক্ষা করার এ রকম মজা আর হাসি থেকে, সংযম আর অধ্যবসায়ের বিস্ময়কর আবেদন থেকে আমরা যেন কখনো বঞ্চিত না হই।

n লেখক :ভারতীয় সাংবাদিক,

সম্পাদক, আরম্ভ পত্রিকা