শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বিশ্বমানের গবেষণা নিয়ে ভাবতে হবে

আপডেট : ১২ ডিসেম্বর ২০১৯, ২১:৩১

সব সময় আমরা একটা ইতিবাচক পরিবর্তন প্রত্যাশা করে থাকি। এই পরিবর্তন যদি দেশের গৌরব ও সমৃদ্ধির  সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে তবে তো কথাই নেই! মানুষই পারে কল্পনার জগত্ সৃষ্টি করতে। ভাবনাটা কাল্পনিক ও স্বপ্ন বলে মনে হতে পারে। কিন্তু এ কথাও আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, কল্পনা আর স্বপ্ন একদিন সম্ভাবনা ও সফলতার জন্ম দেয়। উলটোভাবে একটা বিষয় আমরা ভাবতে পারি। কল্পনা করুন, আমরা গবেষণায় অনেক বেশি এগিয়ে গেছি। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জার্মানি, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, কানাডার মতো দেশগুলো থেকে আমাদের দেশে মাস্টার্স, পিএইচডি করার জন্য তাদের শিক্ষার্থীরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছে! এটাকে একটা অসম্ভব কল্পনা ও স্বপ্ন বলে মনে হতে পারে। কারণ এর বিপরীত ঘটনাটাই ঘটছে। আমাদের দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে এ দেশগুলোতে যাবার জন্য রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নেমেছে। অনেকে ভাবতে ও বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছে যে এসব দেশে যদি ডিগ্রি করা না যায় তবে সব কিছুই বৃথা। অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি ডিগ্রি না থাকলে শিক্ষক হিসেবে নিতে চান না। অনেকে বলতে পারেন বিদেশি ডিগ্রি নেওয়াটা তো দোষের কিছু নয়। সেখানে যে বিশ্বমানের গবেষণা হয় তা তো আমাদের দেশে নেই। কথাগুলো অসত্য নয়। তবে নিজেদেরও তো সমৃদ্ধ করতে হবে, উন্নত হতে হবে। হাত পা ছেড়ে দিয়ে সারাজীবন যদি আমরা উচ্চ শিক্ষার জন্য পরনির্ভরশীল হয়ে বসে থাকি তবে আমাদের কোনোদিনই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সক্ষমতা গড়ে উঠবে না। এখন আমাদের ভাবার সময় এসেছে, কেন আমরা উচ্চ শিক্ষার সক্ষমতা ও স্বকীয়তা গড়ে তুলতে পারিনি। এর জন্য প্রথমত দায়ী আমাদের মানসিকতা। সব সময় আমরা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বদলে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে গুরুত্ব দিয়ে থাকি। গবেষণার বিষয়টি আসলেই আমরা অনেকটা যুক্তিহীন মানসিকতা নিয়ে বলে ফেলি, আমাদের দেশে গবেষণার পরিবেশ নেই। অনেক সময় আমরা গবেষণায় অর্থের অপ্রতুল বরাদ্দের বিষয়টি টেনে নিয়ে আসি। গবেষণায় নিজেদের যেমন সম্পৃক্ত করার মানসিকতা আমাদের থাকে না তেমনি গবেষণায় শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করতেও আমরা কুণ্ঠিত হই। অথচ এই ভূখণ্ডের মাটিতে বসেই বিজ্ঞানীরা এখন থেকে অনেক বছর আগেই বিশ্বমানের গবেষণা করে গেছেন। কিন্তু এখন আমরা বিশ্বমানের গবেষণা বলতে উন্নত দেশগুলোর গবেষণাকেই চিহ্নিত করি। তার মানে সময় যত গড়িয়েছে গবেষণায় আমরা তত পিছিয়েছি। সময়ের সঙ্গে যেটা ঠিক উলটো হবার কথা ছিল। বিশ্বমানের গবেষণায় আমাদের মধ্যে তেমন একটা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। যদিও আমাদের দেশে বসেই কিছুসংখ্যক গবেষক নিভৃতে বিশ্বমানের গবেষণা করে যাচ্ছেন। নেচার, সাইন্সের মতো খুব উঁচু স্তরের জার্নালে এ গবেষণাপত্রগুলো প্রকাশিত হচ্ছে। সারা বিশ্বের কাছে তারা পরিচিত হলেও আমাদের দেশে তাদের যথাযথ মূল্যায়ন নেই। কেন এই সংখ্যাটা কম। যে যেটাই যুক্তি দাঁড় করিয়ে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করুক না কেন সেটার লজিক্যালি কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকছে না। আমাদের অনেক গবেষকই জানেন না কোন স্তরের জার্নালে তার গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করতে হবে। সেটির গুণগত মান কীভাবে পরিমাপ করা যাবে। এই বিষয়গুলো সম্পর্কে আমাদের দেশের গবেষকদের সঠিকভাবে জানানোর জন্য ট্রেনিং ও ডেভেলপমেন্টের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সরকারের গবেষণায় বহুমুখী উদ্যোগের ফলে এখন আমাদের দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহের পরীক্ষাগারে বিশ্বমানের যন্ত্রপাতি ও আনুষঙ্গিক সুবিধা সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু গবেষণার জন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কী কী ধরনের সুবিধা রয়েছে তার কোনো সমন্বিত তালিকা নেই। এজন্য ইউজিসি বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কী কী গবেষণা সুবিধার যন্ত্রপাতি বা অবকাঠামো আছে তার একটি সমন্বিত তালিকা রাখা দরকার। আবার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে পারস্পরিক গবেষণার পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য আইন ও নীতিমালা প্রণীত হওয়া প্রয়োজন। কারণ গবেষণা এখন একমুখী নয়। বরং গবেষণা এখন বহুমুখী। এখনো পর্যন্ত আমাদের দেশে গবেষণার কোনো নীতিমালা নেই। দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের গবেষণা করার জন্য আইসিটি ইনকিউবেটরের কনসেপ্ট অনুযায়ী একটি স্বতন্ত্র গবেষণা কেন্দ্র থাকতে পারে। আমাদের দেশের তরুণরা গবেষণার প্রতি এখন খুব বেশি আগ্রহী হলেও কীভাবে গবেষণা করতে হবে ও গবেষণা করতে কী কী উপাদান বিবেচনায় আনতে হবে সে সম্বন্ধে তাদের কোনো ধারণা নেই। এ ধারণা তৈরি করার জন্য গবেষণা কেন্দ্রগুলো উপযুক্ত স্থান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এর সঙ্গে শিক্ষক ও গবেষকদের আন্তরিকতাও থাকতে হবে। কেবল উচ্চ শিক্ষা স্তরে গবেষণাকে প্রাধান্য না দিয়ে শিক্ষার সব স্তরে গবেষণাকে প্রাধান্য দিতে হবে। এখন খুব সহজে মানুষ ফেসবুক, টুইটার, ম্যাসেঞ্জার, স্কাইপি, ভাইবার, হোয়াটসআপসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বাইরের দেশের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে। আমাদের দেশের গবেষক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ব্যক্তিগতভাবে কিংবা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাইরের দেশের শিক্ষক ও গবেষকদের সঙ্গে এসব সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যোগাযোগ করে সমন্বিত গবেষণা কার্যক্রম চালাতে পারে। সম্প্রতি ইউজিসিতে গবেষণা সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মানসম্পন্ন গবেষণার সংখ্যা খুবই কম। যা আছে তাও পুরোনো ধাঁচের। গবেষণা হতে হবে জনকল্যাণমুখী, যা দেশের মানুষের সমস্যার সমাধান দেবে এবং অন্যদের পথ দেখাবে। উন্নত দেশগুলোর মতো শিল্প কারখানাগুলোর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথভাবে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হতে পারে। এ বিষয়ে শিল্প কারখানাগুলোকে অনুপ্রাণিত করতে শিল্প মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারে। আমাদের দেশে নতুন নতুন উদ্ভাবন হলেও সেটি প্যাটেন্ট করার মতো ধারণা গবেষকদের মধ্যে তৈরি হয়নি। কারণ প্যাটেন্ট করতে গেলে একটি জটিল নিয়মের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এর সঙ্গে অর্থেরও প্রয়োজন হয়। এই উদ্ভাবনসমূহ কীভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় গবেষকরা করতে পারেন তার সঠিক দিকনির্দেশনা ও নীতিমালা থাকা দরকার। অনেকে আমাদের দেশীয় উপাদান ও রিসোর্স ব্যবহার করে গবেষণার কথা বলে থাকেন। নিঃসন্দেহে এটি একটি ভালো মতামত। কিন্তু এটি করতে গিয়ে আমরা প্রাচীন ধাঁচের গবেষণা করছি যা উন্নত বিশ্বে আরো ৫০০-১০০০ বছর আগেই হয়েছে। এখান থেকে বের হয়ে এসে আমাদের দেশীয় উপাদান ব্যবহার করে মৌলিক গবেষণায় আমাদের সম্পৃক্ত হতে হবে। যেমন পাটের আঁশ আমাদের একটি মহামূল্যবান সম্পদ। এটি দিয়ে পণ্য তৈরি করা মৌলিক গবেষণার মধ্যে পড়ে না। কিন্তু এই পাটের ফাইবারের কয়েকটি সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন এটি বর্তমান বিশ্বে বাণিজ্যিকভাবে প্রচলিত গ্লাস ফাইবার, কার্বন ফাইবার ও কেভলার ফাইবারের চেয়ে শক্তির বিচারে অনেক কম। এছাড়া এটি সহজে আর্দ্রতা দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। আবার বাণিজ্যিক ফাইবারগুলোর তুলনায় উচ্চ তাপমাত্রায় টিকে থাকা পাটের ফাইবারের জন্য খুব কঠিন। আমরা যদি পাটের ফাইবারের এই সীমাবদ্ধতাসমূহ গবেষণার মাধ্যমে দূর করে সেগুলো বাণিজ্যিক ফাইবারের পর্যায়ে উন্নীত করতে পারি তবেই সেটি মৌলিক গবেষণা হিসেবে বিবেচিত হবে। এছাড়া আমাদের দেশে অনেক ধরনের গাছের সমারোহ রয়েছে। এই গাছের পাতার নির্যাসকে বের করে এনে আমরা বিভিন্ন ধরনের নতুন ন্যানো পার্টিক্যাল তৈরি করতে পারি, যেগুলো ক্যানসার গবেষণাসহ বিভিন্ন স্তরের গবেষণায় ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখতে পারে। সময় বদলাচ্ছে, প্রতিনিয়ত গবেষণার ধরন বদলাচ্ছে। এ পরিবর্তনশীল গবেষণার ধারাকে পর্যবেক্ষণে রাখতে হলে আমাদের বিশ্বমানের জার্নালসমূহ নিয়মিত পড়তে হবে।

n লেখক : শিক্ষাবিদ, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর