শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

সন্তানকে মুক্ত পরিবেশে বেড়ে উঠতে দিন

আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ২১:৫৬

সাইফুল ইসলাম হাফিজ

প্রাচীনকালের বৈশিষ্ট্য মুছে ফেলে, মধ্যযুগীয় প্রথা পিছনে ফেলে আমরা পৌঁছেছি আধুনিক যুগে। একবিংশ শতাব্দীর ঊনিশ সাল প্রায় শেষ। নতুন বছর দরজায় কড়া নাড়ছে। কয়েক দিন পরেই ২০ সাল পা রাখবে সময়ের পাতায়। পৃথিবী তীব্র গতিতে উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করতে যাচ্ছে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশও এগিয়ে যাচ্ছে। দেশ এগিয়ে গেলেও এখনো আমাদের মধ্যে বাসা বেঁধে আছে মান্ধাতা আমলের কিছু বৈশিষ্ট্য। যেটাকে একদিক থেকে স্বৈরাচারীও বলা যায়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে, গণতান্ত্রিক পরিবেশে বাস করার ফলে আমাদের সবার মস্তিষ্কে গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা জাগ্রত হওয়া প্রয়োজন। অন্যের কাজে বাঁধা না দিয়ে নিজের খেয়াল-খুশিমতো কাজ করাটা ব্যক্তি স্বাধীনতার মূলমন্ত্র। একজন বয়স্ক ব্যক্তির এই স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকার যেমন আছে, একটি শিশুরও তেমন এই স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকার আছে। শিশুর ক্ষেত্রে এই স্বাধীনতার অর্থ হলো তাকে একটি মুক্ত পরিবেশে বেড়ে উঠতে দেওয়া; মুক্তভাবে স্বপ্ন দেখতে দেওয়া, তার ইচ্ছানুযায়ী জীবনের লক্ষ্য স্থির করতে দেওয়া, চাপ প্রয়োগ না করে তাকে শিখতে দেওয়া; কিন্তু আমাদের সমাজে শিশুর এই স্বাধীনতা কি আদৌ আছে? খুব ছোটোবেলায় মাতা-পিতার কোল ছেড়ে যখন বিদ্যালয় যেতে শুরু করে তখনই তার কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হয় মোটামোটা বই আর মস্তিষ্কে দেওয়া হয় ভালো ফলাফল করার তাগিদ। মা-বাবা যেই স্বপ্ন পূরণ করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন কিংবা যে স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন তাদের সেই পুরাতন স্বপ্নগুলো দিয়েই শিশুর জীবনকে সাজিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি চলে জীবন জুড়ে। ঐ শিশু যখন বড়ো হয়ে জীবনের কোনো সময়ে অতীতের হিসেব কষতে বসে, তখন তো তার মনে নিশ্চয়ই কিছু প্রশ্নের উদয় হয় যে, আমি এখানে কেন? আমি কি আসলে এটা হতে চেয়েছিলাম? আমি কি এটা না হয়ে অন্যটা হতে পারতাম না? এই প্রশ্নগুলো যখন প্রকাশ করে তখন হিসেবের খাতায় শূন্যই রয়ে যায়। যখন দশম শ্রেণিতে অধ্যয়ন করি তখন আমার এক বন্ধুর বাবা খুব করেই চাইতেন যে, তার ছেলে আর্টসে (ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে) পড়ে ধর্মীয় দিকে বড়ো একজন আলেম হোক; কিন্তু আমার বন্ধু চাইত সে সাইন্সে পড়ে ইঞ্জিনিয়ার হবে। ধীরে ধীরে গবেষণা করে বিদেশ গিয়ে ভালো কিছু করবে; কিন্তু তার বাবা ছিলেন তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে। ওর টেবিলে প্রায়ই তার, মোটর, বাতিসহ বিভিন্ন বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি দেখা যেত। একদিন ওর বাবা ক্ষুব্ধ হয়ে ঐ যন্ত্রপাতিগুলো খালে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এই প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও কিছুদিন পরে আমার বন্ধু জেলা বিজ্ঞান মেলায় ডিভাইস প্রদর্শনী প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করে। এই খবর শুনে ওর বাবা কান্নারত অবস্থায় ওকে বুকে জড়িয়ে বলে যে ‘বাবা, আমি কি তোকে খুব বেশি শাসন করেছি?’ এই প্রশ্নের উত্তর ও তখন দেয়নি। শুধু বলেছে ‘ভালোবাসি বাবা’। সন্তানের স্বপ্ন কী? ও কী হতে চায়? তা জানার চেষ্টা করা হয় না। উলটো তোকে ডাক্তার হতে হবে, তোকে ইঞ্জিনিয়ার, লইয়ার, আলেম হতে হবে; তার জন্য তোকে প্রচুর পড়াশোনা করে ভালো রেজাল্ট করতে হবে। রেজাল্ট করার দরুন ফোর-ফাইভে পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থীর পিছনে পাঁচ-ছয় জন গৃহশিক্ষক রেখে দেওয়া হয়। সময়মতো খেতে হয়, ঘুমাতে হয়। মুক্ত পরিবেশে একটু নিঃশ্বাস নেওয়ারও সুযোগ মেলে না। আরেক জনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে জীবন শেষ হয়ে যায়। নিজের ইচ্ছেগুলো অপ্রকাশিতই থেকে যায়, কখনো বাস্তবতার মুখ দেখে না। আর লালিত স্বপ্নগুলো চাপা পড়ে দুমড়েমুচড়ে যায় নিজের অন্তরে। সম্মানিত অভিভাবকগণ প্রশ্ন করতে পারেন যে, আমরা সন্তানকে জন্মের পর থেকে লালনপালন করি, নিজেরা শিখরসম কষ্ট করে সন্তানকে অর্থ দিয়ে থাকি, প্রয়োজনে নিজেরা না খেয়েও সন্তানের মুখে দু মুঠো খাবার তুলে দিতে একবিন্দু কার্পণ্য করি না। আমাদের কি সন্তান নিয়ে কোনো আশা-ভরসা থাকতে পারে না? আমরা কি তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারি না? হ্যাঁ অবশ্যই পারেন; আপনি সন্তানকে অঢেল ভালোবাসা দিয়ে যেরূপ বড়ো করে তোলেন, তেমনি ওর স্বপ্নটাকে বড়ো করে তুললে আপনার আশা কি ব্যাহত হবে? সন্তানের প্রতিটি বায়না যেরূপ আপনার শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও পূরণ করেন। আপনার সন্তানের নিজস্ব স্বপ্নটা পূরণে সহযোগিতা করা আপনার দায়িত্ব নয় কি? আপনার সন্তান মানুষের মতো মানুষ হবে—এটাই তো আপনার আশা। তবে সন্তান তার স্বপ্ন পূরণ করে মানুষের কাতারে শামিল হলে দোষ কোথায়? শাসনের নামে শোষণ হলে অবাধ্য হওয়াটা তো স্বাভাবিক। সন্তানকে মুক্ত পরিবেশে বেড়ে উঠতে দিন। তার নিজস্ব স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নে পাশে থাকুন। আগামীর সমাজে দেখা মিলবে বিখ্যাত লোকের মতো একজন বিরাট একটা কিছু।

n লেখক :শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়