বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

হংকং আপাতত শান্ত

আপডেট : ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ২২:৫৮

নাদিরা মজুমদার

শয়ে শয়ে তরুণ হংকংবাসী হংকংয়ে অবস্থিত ব্রিটিশ কনসুলেটের সামনে ‘গড সেইভ দ্য কুইন’ এবং ‘গ্রেট ব্রিটেন সেইভস হংকং’য়ের চীত্কার থেমেছে। বিক্ষোভকারীরা নেই, তাই তাদের ভিড়ে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের ব্যস্তসমস্ত ‘কূটনীতিকেরাও’ নেই। স্থানীয় নির্বাচনে ১৮টি শহরের মধ্যে ১৭টিতে গণতন্ত্রপ্রেমীরা জয়ী হয়েছে। ১৩০ জন ব্রিটিশ এমপি প্রাক্তন উপনিবেশের জনসমষ্টিকে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব প্রদানের সুপারিশ বা আবেদন করেছেন। ফলে বিশ্ব জনমতের মাপকাঠিতে, বিশেষত তরুণদের কাছে যুক্তরাজ্য বৈধতা ও মানবাধিকারের জামিনদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। 

তরুণ হংকংবাসীদের অন্তত ১০ শতাংশও যদি ‘প্রথম ও দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ’পূর্ব পূর্বপুরুষদের কাহিনি এবং পরবর্তীকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যিক শাসনের ইতিহাস জানত, তো ‘হংকংয়ের’ বিষয়টি কি অন্যরকম হতো না? হতো। জানত যে ওদের দাদা-দাদি নানা-নানির বাবা-মায়েদের কঠিন দুর্দশা উচ্ছিন্নতার মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল লন্ডন, জানত যে কিং ডাইনেস্টি  (Qing dynasty) ভেঙে তছনছ করে চৈনিক ঐতিহ্যের বিলুপ্তি ঘটিয়েছে ব্রিটিশরাজ। ১৯৯৭ সালে চীন প্রজাতন্ত্র যে হংকং ও তার অধিবাসীদের ফিরে পেল, সাংস্কৃতিকভাবে তারা দস্তুরমতো ব্রিটিশ। হংকং বিশেষ প্রশাসনিক বিভাগ হিসেবে সরাসরি চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ হয় এবং তাকে সর্বোচ্চ পরিমাপের স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়।

এবার চীনা ভূখণ্ড হংকং কী করে ব্রিটিশরাজের দখলে আসে সেই কাহিনি সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক!

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মোগল সম্রাটের দরবারে যেমন ব্যবসা-বাণিজ্যের দোহাই দিয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশাধিকার পেয়েছিল, সেই একই দোহাই দিয়ে তারা তথা ইংরেজরা ‘কিং ডাইনেস্টির’ রাজ্যে প্রবেশাধিকার পায়। তামাম ভারতবর্ষ তখন ইংরেজের অধীনে, আফিমের একচেটিয়া বাণিজ্যও তাদের দখলে। ‘মুক্তবাজারের’ সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে তারা জাহাজবোঝাই আফিম এনে এনে চীনে আফিম বিতরণের ব্যবসা চালু করে। ব্যবসা দ্রুত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে থাকে। একপর্যায়ে চীনা রাজকীয় কর্তৃপক্ষের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে এবং ক্যান্টনের সব আফিমের গুদাম বাজেয়াপ্ত করে ও পুড়িয়ে দেয়। ব্রিটিশরাজ তখন সেনাদল পাঠিয়ে ক্যান্টনসহ উপকূলীয় শহরগুলো দখল করে নেয়। এই সামরিক সংঘর্ষ ইতিহাসে ‘আফিম যুদ্ধ’ নামে পরিচিত।

এই যুদ্ধের অবসান ঘটে ‘নানজিং চুক্তি’র মাধ্যমে। ১৮৪২ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তিবলে রাজকীয় চীন ‘যুক্তরাজ্যের মহামাননীয় রানি ও তার উত্তরাধিকারীদের কাছে চিরকালের জন্য হংকংয়ের দাবি পরিত্যাগ করে’ এবং ‘ক্ষয়ক্ষতির খেসারত বাবদ ১২ মিলিয়ন ডলার দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়’। ১৮৯৮ সালের মধ্যে ব্রিটিশরাজ হংকংয়ের কাউলুন উপদ্বীপ দখল করে নেয় এবং ‘নিউ টেরিটরিজ’ নাম ধারণ করে। রাজকীয় চীন ব্রিটিশদের কাছে হংকংকে ৯৯ বছরের জন্য ‘ভাড়া’ দিতে বাধ্য হয়। এভাবে ‘নানজিং চুক্তি’ নামক অসম চুক্তির মাধ্যমে উনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় শক্তিসমূহ, যেমন :যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া (অস্ট্রোহাঙ্গেরি), ইতালি, জারের রাশিয়া, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র—সামরিক বলের সাহায্যে চীনে প্রভাব বিস্তার করে।

বোধগম্য কারণেই বিদেশিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক মাত্রায় ক্ষোভ ও অসন্তোষ জমাকৃত হতে থাকে এবং ফলস্বরূপ ‘বক্সার অভ্যুত্থান’ ঘটে (১৮৯৯-১৯০১)। ‘বক্সারদের’ বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ আরো ৯টি ইউরোপীয় দেশের সম্মিলিত শক্তিবল বিজয়ী হয়। ১৯০৩ সালে ব্রিটিশরা তিব্বতের নিয়ন্ত্রণ নেয়, ১৯০৭ সালে জারের রাশিয়া ও জাপান মাঞ্চুরিয়াকে ভাগাভাগি করে নেয়। প্রায় উপনিবেশে পরিণত হয় চীন, হংকং হয় লুণ্ঠিত সম্পদ এবং দাস-শ্রমের প্রধান বিনিময়কেন্দ্র। ফলস্বরূপ, বিপুলসংখ্যক চীনা যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে চলে যেতে বাধ্য হয়।

এবারে হংকংয়ের রাস্তায় কারা ছিল বিক্ষোভকারী জনতা?

সদা স্পন্দমান বাণিজ্য শহর হংকংয়ের ১৫-১৬ শতাংশ অধিবাসী দরিদ্রাবস্থায় রয়েছে। হংকংয়ে মাসিক গড় বেতন যদিও প্রায় ২হাজার ২০০ ডলারের সমতুল্য, কিন্তু অদক্ষ শ্রমশক্তির মাসিক বেতন ১ হাজার ২০০ মার্কিন ডলার মাত্র। বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘিষ্ঠের সদস্যরা সাধারণত অদক্ষ শ্রমে নিয়োজিত। তারা ক্যান্টোনিজ, ইংরেজি কোনো ভাষাই জানে না। তাদের জন্য কল্যাণব্যবস্থাও নেই। ১৯৪৯ সালে এদের পূর্বপুরুষেরা অর্থনৈতিক উদ্বাস্তু হিসেবে আসে। এই দলের ভাগ্য বরাবর কঠিন, নিমর্ম থেকে যায়। রয়েছে ১৯৪৯ সালে মাও জেদং বিজয়ী হলে পালিয়ে আসা পুরোনো চীনা এলিটের দল, চিয়াং কাইশেকের ‘এই এতিমের’ দল কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে যে গভীর প্রতিহিংসামিশ্রিত ঘৃণা নিয়ে জীবনযাপন করে, সেটি বংশধরদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়। স্বল্প ধনীরা হংকংয়ে কোনো রকমে ৫ মিলিয়ন ডলারের ফ্ল্যাটবাড়ির মালিক। ফোর্বসের রিপোর্ট মতে, হংকংয়ে আলট্রাধনী যে ২০ জন রয়েছেন, তাদের অধিকাংশই ‘প্রপার্টি মার্কেটের’ সঙ্গে জড়িত এবং সম্মিলিতভাবে ২৩৪ বিলিয়ন ডলারের মালিক। আলট্রাধনীরা হংকংয়ে থাকেন না, তাদের প্রিয় শহর কানাডার ভ্যাঙ্কুভার।

কাজেই কার্যত হংকংয়ের সবারই প্রতিবাদে শরিক হওয়ার কারণাদি রয়েছে। কিন্তু হংকংয়ে ঘটে যাওয়া ড্রামার সজ্জিতকরণের রীতি যা ছিল, ছিল ‘এক’ নয়, ‘পয়েন্ট এক’ শতাংশের জন্য উপযোগী। আসলে ছিল বৃহত্তর চিত্রের মিনিয়েচার সংস্করণ। যেমন ইউরোপের ‘ব্ল্যাকব্লকের’ কৌশল বা ট্যাকটিসে সজ্জিত খুদে অংশ ধ্বংসের নিমিত্তে ধ্বংসযজ্ঞে নামে। তারা ‘ওয়ান চাই’ স্টেশনের প্রবেশপথে আগুন লাগায় বা ‘অ্যাডমিরাল্টি’র কাচ ভাঙে বা কর্মব্যস্ত দিনে হংকংয়ের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দখল করে! এই বাস্তবতার বিপরীতে ভাবাই অসম্ভব যে ‘ব্ল্যাকব্লক’রা প্যারিসের ‘শার্ল ডি গল’ বা ‘হিথরো’ কিংবা নিউ ইয়র্কের ‘জেএফকে’ দখল করে নিয়েছে। ২০১৭ সালে হামবুর্গে যে জি-২০-এর সম্মেলন হয়েছিল, সেখানে ‘ব্ল্যাকব্লক’ লুণ্ঠনকারীদের ঠেকাতে জার্মানি স্পেশাল ফোর্স মোতায়েন করেছিল। 

বিক্ষোভের প্রধান উপাদান হিসেবে সৃষ্টি হয় ‘স্বাধীন হংকং আন্দেলনের’, সংবাদ সম্মেলনের মধ্য পর্যায়ে ব্রিটিশ হংকংয়ের পতাকা ওড়ানো হয়। বিক্ষোভকারীদের এক অংশ আবার যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, ক্যানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান, পোল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, ইউক্রেইন, যুক্তরাষ্ট্র, তাইওয়ান ও ব্রিটিশরাজের হংকংয়ের পতাকা উড়িয়ে প্রতিবাদ করে। আরেক দল আবার ‘ব্রিটিশ ওভারসিজ পাসপোর্টের’ বদলে সত্যিকারের আশ্রয়প্রাার্থীর আবেদন করে।

চিয়াং কাইশেকের ‘অর্থনৈতিক উদ্বাস্তুদের’ বংশধররা কালো জামাকাপড় পরে ‘গ্লোরি টু হংকং’ গাইছে আর ‘স্বাধীনতা’র স্বপ্ন দেখছে—তারা আসলে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যখানের ফাঁদে পড়েছে। একদিকে তারা পাশ্চাত্য জীবনপ্রণালিতে অভ্যস্ত, অপরদিকে নিজস্ব চীনা সংস্কৃতি ও ইতিহাস সম্বন্ধে একেবারেই অজ্ঞ থেকে গেছে।

n লেখক :আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক