শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

পানযোগ্য স্বাদু পানির সংকটে বিশ্ব

আপডেট : ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ২২:৫৯

আফসানা রিজোয়ানা সুলতানা

আমাদের বেঁচে থাকার জন্য পানি অপরিহার্য। ভূপৃষ্ঠের প্রায় ৭১ শতাংশ এলাকা জুড়ে রয়েছে পানি। কিন্তু এই পানির প্রায় ৯৭ শতাংশই হলো লবণাক্ত, বাকি ৩ শতাংশ পানযোগ্য স্বাদু পানি। এই ৩ শতাংশ পানির আবার দুই শতাংশই বরফ আকারে রয়েছে, যা সহজপ্রাপ্য নয়। তাই সংগত কারণেই পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশ জুড়ে বিভিন্ন সাগর ও মহাসাগর থাকলেও বর্তমানে পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশই পানযোগ্য স্বাদু পানির সংকটের শিকার।

বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, ২০২৫ সাল নাগাদ পৃথিবী জুড়ে প্রায় ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন মানুষ স্বাদু পানির সংকটে ভুগবে। ২০১০ সালে নেচারে প্রকাশিত এক জার্নাল থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, পৃথিবীর প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ স্বাদু পানি নিরাপত্তা হুমকির মুখে এমন এলাকায় বসবাস করে। পৃথিবীতে যে হারে মানুষ বাড়ছে, তার প্রায় দ্বিগুণ হারে বাড়ছে পানির চাহিদা। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৪০ সাল নাগাদ প্রায় ২০টি দেশ এবং ২০৫০ সাল নাগাদ প্রায় ৫ বিলিয়ন মানুষ পানির তীব্র সংকটের সম্মুখীন হবে। কনসাল্টিভ গ্রুপ অব ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ পানির সংকটের মুখে রয়েছে এমন কয়েকটি দেশের তালিকা করেছে। তালিকার ওপরের দিকে রয়েছে উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, ভারত, কেন্দ্রীয় এশিয়া, চীন, চিলি, কলোম্বিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া। ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে পানির তীব্র সংকট রয়েছে। উত্তর প্রদেশে মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয় শুধু একটু বিশুদ্ধ পানির খোঁজে। ভারতের কয়েকটি রাজ্যের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। কাভেরি, কৃষ্ণ, রবি, নর্মদা, গোদাভরি ইত্যাদি নদ-নদীর পানির বণ্টন নিয়ে রাজ্যগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায়ও পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটসহ দেশের দক্ষিণের জেলাগুলোয় পানিতে লবণের পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বর্তমানে পৃথিবীতে পানির সংকটের প্রধান তিনটি কারণ হলো অতীতের তুলনায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাওয়া, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া এবং স্বাদু পানির উত্সগুলো হ্রাস পাওয়া। একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আমরা যে পরিমাণ পানি খরচ করি, তার একটা ক্ষুদ্র অংশ বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে আবার ফিরে আসে। তাই পানির সংকটের সমাধান করতে হলে আমাদের প্রথমেই পানির পুনর্ব্যবহারের (Recycling of Water) দিকে মনযোগী হতে হবে। অন্যদিকে স্বাদু পানির একটি বড়ো অংশ ব্যবহার করা হয় কৃষিকাজে। তাই বিভিন্ন ধরনের সেচসাশ্রয়ী ফসল উত্পাদনের মাধ্যমে আমরা পানির সংকট অনেকটা কমিয়ে আনতে পারি। একজন মানুষ প্রতিদিন যে খাবার খায়, সেটা উত্পাদনের জন্য প্রায় ৩ হাজার ৫০০ লিটার পানির প্রয়োজন হয়। তাই খাবারের অপচয় রোধ করার মাধ্যমেও পানি সংরক্ষণ করা সম্ভব। অন্যদিকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে আমরা আমাদের পানির চাহিদা অনেকটা মেটাতে পারি। ১ হাজার বর্গফুট ছাদে ১ ইঞ্চি পরিমাণ বৃষ্টিপাত হলে প্রায় ৬০০ গ্যালন পানি জমা হয়। এই বিপুল পরিমাণ পানি অব্যবহূত রাখা কোনো ভালো কথা নয়। তাই বর্তমানে স্বাদু পানির সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বৃষ্টির পানির পূর্ণ ব্যবহারের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। সমুদ্রের তীরবর্তী দেশ বারমুডা এক্ষেত্রে একটা দৃষ্টান্ত হতে পারে। চারদিকে লোনা পানি দিয়ে ঘেরা দেশটি তাদের পানির প্রায় পুরো চাহিদাই মেটায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে। জলবায়ুর পরিবর্তন তথা পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পানির সংকটের অন্যতম কারণ। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীর বরফ গলে সমুদ্রের সঙ্গে মিশে যাওয়ায় স্বাদু পানির উত্স ক্রমাগত ছোট হয়ে আসছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের নিয়ামকগুলো কমিয়ে আনতে আমাদের সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে।

বিশ্ব জুড়ে পানির সংকটের সমাধান হিসেবে যে বিষয়ের ওপর সব থেকে বেশি জোড় দেওয়া হচ্ছে, তা হচ্ছে পানি নির্লবণীকরণ। কিন্তু সমুদ্রের লোনা পানিকে লবণমুক্ত করে পানযোগ্য এবং কৃষিকাজে ব্যবহার করা অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ একটি পদ্ধতি, যা পানির সংকটে থাকা সব দেশের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সংগত কারণেই পানি নির্লবণীকরণের দিকে মনোযোগ না দিয়ে আমাদের উচিত পানি সংরক্ষণ ও পুনর্ব্যবহারের দিকে মনোযোগ দেওয়া।  পানির তীব্র সংকটের মুখে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে না, সেই আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। পানির সংকটে থাকা দেশগুলো পানি নিয়ে  ভবিষ্যতে বিরোধে জড়িয়ে পড়তে পারে, এ ব্যাপারে একমত অনেকেই। ধারণা করা হয়, আগামী শতাব্দীতে বিশ্বযুদ্ধ হবে পানি নিয়ে। ১৯৬৭ সালে যে আরব-ইসরাইল যুদ্ধ হয়েছিল, তার অন্য একটি নিয়ামক ছিল পানি। শাত-ইল-আরব নদী নিয়ে ইরান ও ইরাকের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। ভারত-পাকিস্তান ও ভারত-চীনের মধ্যে বেশ কয়েকটি নদীর পানি বণ্টন নিয়ে সমস্যা রয়েছে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মধ্যে অবস্থিত নদীগুলোর পানি বণ্টন নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে। ভবিষ্যতে পানির সংকট প্রকট হলে এ সমস্যা আরো বৃদ্ধি পাবে। বিভিন্ন স্বাদু পানির উত্সগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ দাবি করতে চাইবে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো। এতে বিশ্ব জুড়ে বৃদ্ধি পাবে অস্থিরতা। এর পরিপ্রেক্ষিতে একটা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

n লেখক :শিক্ষার্থী, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়