শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

জাগ্রত হোক জীবনবোধ

আপডেট : ২৯ ডিসেম্বর ২০১৯, ২২:০৬

মানুষ পৃথিবীতে জন্ম নেয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমাগত বেড়ে ওঠে এবং একসময় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে। বাস্তব পক্ষে মৃত্যুর মতো সত্য আর পৃথিবীতে কিছু নেই। মৃত্যুকে সত্য জেনেও মানুষ একটার পর একটা লোভের চোরাবালিতে আবর্তিত হয়। এই লোভ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তেই থাকে। এটিকে থামানো কেবল কঠিন নয়, দুঃসাধ্যও বটে। সম্পদ আর অর্থ উপার্জনের নেশা মানুষকে পেয়ে বসে। হোক না সেটা বৈধ কিংবা অবৈধ। পতঙ্গ যেমন ভ্রান্তিবিলাসে ভুগে আগুনকে আলিঙ্গন করে, মানুষ তেমনি লোভের নেশায় বুঁদ হয়ে আত্মঘাতী হয়ে ওঠে। এতটাই লোভ মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে যে মানুষ বুঝতেও পারে না সে ক্রমশ লোভের ক্রীতদাসে পরিণত হয়। মানুষ থেকে ধীরে ধীরে লোভী মানুষে তার রূপান্তর ঘটে।

বিশ্বখ্যাত পপসম্রাট মাইকেল জ্যাকসনের ১৫০ বছর বেঁচে থাকার স্বপ্ন ছিল। দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার জন্য তিনি অনেকগুলো আত্মরক্ষা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। কোনো মানুষের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করার সময় তিনি দস্তানা ব্যবহার করতেন। জীবাণু থেকে বাঁচার জন্য মুখে মাস্ক লাগানো থাকত। তার সারা শরীর প্রতিদিন পরীক্ষা করা ও চিকিত্সাসেবা দেওয়ার জন্য ১২ জন চিকিত্সক সার্বক্ষণিকভাবে নিয়োজিত ছিলেন। খাদ্যে কোনো ধরনের বিষক্রিয়া বা জীবাণু আছে কি না, তা নিয়মিতভাবে শনাক্ত করার জন্য ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ব্যবস্থা ছিল। ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরকে সুস্থ রাখতে ১২ জন বিশেষজ্ঞ ও ফিজিওথেরাপিস্ট নিযুক্ত ছিলেন। অক্সিজেনের অভাবে যাতে মৃত্যু না ঘটে, সে কারণে অক্সিজেনযুক্ত বিছানায় ঘুমাতেন। কিডনি, ফুসফুস, চোখ, লিভার, হূিপণ্ডসহ শরীরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বিকল হয়ে পড়লে সেগুলো যাতে দ্রুত মাইকেলের দেহে প্রতিস্থাপন করা যায়, সেজন্য সার্বক্ষণিকভাবে অর্গান ডোনার বা অঙ্গদাতা রাখা হয়েছিল। কিন্তু এত সব সুরক্ষার ব্যবস্থা করেও মাইকেল জ্যাকসনের দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকার স্বপ্ন সফল হয়নি। ২০০৯ সালের ২৫ জুন মাত্র ৫০ বছর বয়সে না ফেরার দেশে চলে গেলেন তিনি। মৃত্যুকে হার মানানোর চেষ্টা তার থমকে গেল। মৃত্যুর কাছে জীবন হার মানল। তার বাসায় কর্মরত ১২ জন চিকিত্সকের কোনো প্রচেষ্টাই সফল হলো না। লস অ্যাঞ্জেলেস, ক্যালিফর্নিয়ার বিশ্বখ্যাত চিকিত্সকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা তার জীবনকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারল না।

মৃত্যু অনিবার্য। এটাই চিরন্তন সত্য ও প্রকৃতির নিয়ম। জীবন আছে বলেই মৃত্যু আছে। তারপরও মানুষ ভাবে সারা জীবন সে বেঁচে থাকবে। বেঁচে থাকার আশা, স্বপ্ন ও বিশ্বাস মানুষের মধ্যে থাকতে হবে। এটা যেমন সত্য, তেমনি সময়ের পরিক্রমায় কিংবা যে কোনো মুহূর্তে যে মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হতে পারে, এ বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। কিন্তু সমাজবিজ্ঞান, মনস্তত্ব ও অপরাধবিজ্ঞান বলছে, মানুষ এখন মৃত্যুকে ভুলে গিয়ে ক্রমাগত নেতিবাচক কাজে লিপ্ত হচ্ছে। মানবিক আচরণ দানবিক আচরণে পরিণত হচ্ছে। মানুষের অহংকার মানুষকে ভাবতে শেখাচ্ছে, সে সারাজীবন বেঁচে থাকবে। মানুষ এখন ভুলতে বসেছে, পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ সময় আর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে মানুষের জন্য কিছু করা। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের চেয়ে সামগ্রিক স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া। আত্মত্যাগ, মানবিক মূল্যবোধ, দেশপ্রেম, সততা, নৈতিকতা মানুষের আচরণকে প্রভাবিত করতে পারছে না। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সময়ের সঙ্গে বস্তুর যেমন ক্ষয় ঘটে, তেমনি সময়ের সঙ্গে মানুষ ক্রমাগত মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়। কেবল সময় নয়, জরা-ব্যাধিতে মানুষের মৃত্যু হয়, নানা ধারার দুর্ঘটনায় পতিত হয়েও সময়ের আগেই মানুষের মৃত্যু ঘটে, স্বাভাবিক অবস্থায়ও মানুষকে মৃত্যু গ্রাস করে। এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞানের তেমন যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ নেই। এমন ধরনের ব্যতিক্রমী মৃত্যুর ব্যাখ্যায় জায়গা করে নেয় অতিবাস্তবতা, পারলৌকিক সত্য এবং আধ্যাত্মিকতার মতো ধারণাসমূহ।

সমরেশ মজুমদার লিখেছেন, মৃত্যু কি সহজ, কি নিঃশব্দে আসে; অথচ মানুষ চিরকালই জীবন নিয়ে গর্ব করে যায়। বাস্তবিকই জীবন নিয়ে গর্বের কিছু নেই। পৃথিবীতে মানুষ একাই আসে, একাই চলে যায়। ধন-সম্পদ, অর্থ, অহমিকা, ক্ষমতা সবকিছু পড়ে থাকে। একসময় কালের গর্ভে হারিয়ে যায়। বিশ্বজয়ী আলেকজান্ডারের নিজের দৃষ্টিভঙ্গির দর্শনে তার প্রকাশ ঘটেছে। মৃত্যুশয্যায় আলেকজান্ডার। তার প্রিয় সেনাপতিকে কাছে ডাকলেন এবং তার মৃত্যুর পর তিনটি ইচ্ছা পূরণ করার কথা বললেন। আলেকজান্ডার তাদের অলৌকিক দর্শনতত্ত্ব থেকে বললেন, ‘আমি আমার জীবনের বিনিময়ে তিনটি বিষয় শিখেছি, সেগুলো পৃথিবীর মানুষকে জানাতে চাই। প্রথমত, আমার শবদেহ চিকিত্সকেরা বহন করবে, যাতে মানুষ বুঝতে পারে মৃত্যুর সময় যখন ঘনিয়ে আসে, তখন পৃথিবীর কোনো চিকিত্সকের পক্ষে মৃত্যুকে রোধ করা সম্ভব নয়।’ দ্বিতীয় ইচ্ছার বিষয়ে আলেকজান্ডার বলেন, ‘আমার শবদেহ যে পথ দিয়ে বহন করে সমাধিক্ষেত্রের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে, সেই পথের চারপাশে আমার অর্জিত ধন-সম্পদ ও অর্থ ছড়িয়ে দেবে। যাতে মানুষ বুঝতে পারে আমি আমার পুরো জীবন ধন-সম্পদের পেছনে ব্যয় করলেও মৃত্যুর পর তার কিছুই সঙ্গে করে নিতে পারছি না।’ তৃতীয়ত, ‘কফিনের বাইরে হাত বের করে রাখবে। কারণ আমি পৃথিবীকে বোঝাতে চাই, আমি পৃথিবীতে শূন্য হাতে এসেছিলাম; আবার যাওয়ার সময় শূন্য হাতেই ফিরে যাচ্ছি।’

স্টিভ জবস বলেছেন, ‘মৃত্যুই আমাদের সবার গন্তব্য। কেউ কখনো এটা থেকে পালাতে পারেনি। এবং সেটাই হওয়া উচিত। কারণ মৃত্যুই সম্ভবত জীবনের অন্যতম বড়ো আবিষ্কার। এটা জীবনে পরিবর্তনের এজেন্ট। এটা পুরোনোকে ঝেড়ে নতুনের জন্য জায়গা করে দেয়।’ কথাটির প্রতিফলন ঘটেছে স্টিভ জবসের জীবনে। প্রচুর ধনসম্পদ রেখে গেলেও ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৫৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। এই বিপুল সম্পদ তার ক্যানসারকে নির্মূল করতে পারেনি। মৃত্যুর কাছে সম্পদ মূল্যহীন। সম্পদ দিয়ে মৃত্যুকে কখনো কেনা যায় না। একই ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলেন বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার, ব্লগার, সেলিব্রেটি ও লেখক কিরজেইডা রডরিগুয়েজ। তার জীবনের ব্যাপ্তি ছিল আরো কম। মাত্র ৪০ বছর। ক্যানসার তার শরীরেও বাসা বাঁধে। মৃত্যুকে খুব কাছাকাছি দেখছিলেন। গভীর অনুভূতি থেকে জন্ম নিয়েছিল জীবনবোধ। মৃত্যুর আগে লিখে যাওয়া একটি নোটে তিনি উল্লেখ করেন :পৃথিবীর সবচেয়ে দামি ব্র্যান্ডের গাড়িটি আমার গ্যারেজে পড়ে আছে। কিন্তু আমাকে বসে থাকতে হয় হুইল চেয়ারে। সব রকমের ডিজাইনের কাপড়, জুতা, দামি জিনিসে আমার গৃহ ভরপুর। কিন্তু আমার শরীর ঢাকা থাকে হাসপাতালের দেওয়া সামান্য একটা চাদরে। ব্যাংকভর্তি আমার টাকা। কিন্তু সেই টাকা এখন আর আমার কোনো কাজে লাগে না। প্রাসাদের মতো আমার গৃহ, কিন্তু আমি শুয়ে আছি হাসপাতালের টুইন সাইজের একটা বিছানায়। এক ফাইভস্টার হোটেল থেকে আরেক ফাইভস্টার হোটেলে আমি ঘুরে বেড়াতাম। কিন্তু এখন আমার সময় কাটে হাসপাতালের এক পরীক্ষাগার থেকে আরেক পরীক্ষাগারে। শত শত মানুষকে আমি অটোগ্রাফ দিয়েছি, আর আজ ডাক্তারের লেখা প্রেসক্রিপশনটাই আমার অটোগ্রাফ। আমার চুলের সাজের জন্য সাত জন বিউটিশিয়ান ছিল, আজ আমার মাথায় কোনো চুলই নেই। ব্যক্তিগত জেটে আমি যেখানে খুশি সেখানেই উড়ে যেতে পারতাম। কিন্তু হাসপাতালের বারান্দায় যেতেও এখন আমার দুজন মানুষের সাহায্য নিতে হয়। পৃথিবীব্যাপী ভরপুর নানা খাবার থাকলেও দিনে দুটি পিল আর রাতে কয়েক ফোঁটা স্যালাইন আমার খাবার। এই গৃহ, এই গাড়ি, এই জেট, এই আসবাবপত্র, এত এত ব্যাংক একাউন্ট, এত সুনাম আর এত খ্যাতি—এগুলোর কোনো কিছুই আমার আর কোনো কাজে আসছে না। এগুলোর কোনো কিছুই আমাকে একটু আরাম দিতে পারছে না। শুধু দিতে পারছে প্রিয় কিছু মানুষের মুখ আর তাদের স্পর্শ।’

মৃত্যুর চেয়ে চরম সত্যি আর কিছু নেই। ক্রমাগত মানুষের পচন দেখা যাচ্ছে। দুর্নীতি, অনিয়ম আর অনৈতিকতার মাধ্যমে মানুষ সম্পদের পর সম্পদ গড়ে তুলছে। চারপাশের অসহায় নিরন্ন মানুষগুলোর জন্য যে মানুষের অনেক কিছু করার আছে তা বুঝে উঠতে পারছে না। একদিন সবকিছু মৃত্যু এসে কেড়ে নেবে, কেবল বেঁচে থাকবে মানুষের অবদান। সেই অবদানের প্রতিদান মানুষ দিতে জানে। অমরত্ব ও মর্যাদা মানুষ ধন-রত্ন ও অর্থের মাধ্যমে লাভ করে না; আত্মত্যাগ, উদার দৃষ্টিভঙ্গি আর সৃষ্টি মানুষকে মৃত্যুর পরও বাঁচিয়ে রাখে।

n লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর