শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

পরীক্ষার্থী নয়, শিক্ষার্থী চাই

আপডেট : ২৯ ডিসেম্বর ২০১৯, ২২:০৬

প্রতি বছর আমাদের দেশে গণনা করা হচ্ছে কত সংখ্যক ছাত্রছাত্রী পিএসসি পরীক্ষায়, জেএসসি পরীক্ষায়, এসএসসি পরীক্ষায়, এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে, কত সংখ্যক জিপিএ-৫ পেয়েছে। গণনা তো দূরে থাক—কয়জন আছে শুধুমাত্র এই চিন্তাটুকু করেছে যে, আমাদের দেশে কত লক্ষ নয়, কত জন শিক্ষার্থী আছে যাদের আমরা সত্যিকার অর্থে গর্ব করে বলতে পারি যে, তারা বাংলাদেশের শিক্ষার্থী!

জিপিএ-৫-এর সংখ্যা বৃদ্ধির কোনো ভিত্তি নেই, যদি না আমাদের দেশের সত্যিকারে সেই আকাঙ্ক্ষিত আদর্শ শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি না হয়। আর যাই হোক, ভালো পরীক্ষার্থী আর ভালো শিক্ষার্থী হওয়া এক জিনিস নয়।

তার প্রমাণ আমাদের চোখে স্পষ্ট হয়ে পড়ে যখন দেখি বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া সেই মেধাবী শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ অঙ্গনে দুর্নীতি আর গুন্ডামির বন্যা ভাসিয়ে দিচ্ছে!

ছোটবেলা থেকেই আমরা আমাদের জীবনপথে বিভিন্ন লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে বড়ো হচ্ছি এবং তা কীভাবে পূরণ করা যায় সে প্রচেষ্টা চালাচ্ছি! যেমন আমাকে পরীক্ষায় পাশ করতে হবে, আমাকে জিপিএ-৫ পেতে হবে, আমাকে বৃত্তি পেতে হবে, আমাকে ভালো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতে হবে, আমাকে ভালো একটা চাকরি পেতে হবে ইত্যাদি। আমরা যতই আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন, লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছি ততই আমরা পরীক্ষার্থী হবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছি শিক্ষার্থী হবার জন্য নয়।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সৃজনশীলতা আনয়ন করা হয়েছিল মেধার বিস্তার ঘটাতে কিন্তু মেধার বিস্তার ঘটছে না। কারণ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সৃজনশীল করার আগে শিক্ষাদান পদ্ধতি সৃজনশীল করা দরকার ছিল! তারও আগে দরকার শিক্ষাব্যবস্থায়  শিক্ষার্থীদের মাঝে নীতি-নৈতিকতার বিস্তার ঘটানো!

যে জাপান একসময় দুর্ধর্ষ জাতি ছিল, তারা আজ শিক্ষার গুণমানে নৈতিকতা অর্জন করে বর্তমান সভ্যতার চরম শিখরে আরোহণ করছে! জাপানে ১০ বছর বয়স পর্যন্ত অর্থাত্ চতুর্থ গ্রেড পর্যন্ত কোনো শিক্ষার্থীকে পুথিগত বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয় না! সেখানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক মানসিক ও চারিত্রিক দিকগুলোর ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়! আর আমাদের দেওয়া হয় একাডেমিক সিলেবাসের ওপর তিরন্দাজের মতো মনোযোগ!

আমাদের একাডেমিক শিক্ষার ওপর মনোযোগ কম দিয়ে বহির্জগতে প্রবেশ করিয়ে সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের সুযোগ দিতে হবে, চারিত্রিক গুণাবলি অর্জনের ওপর জোর দিতে হবে! যদি তা সম্ভব হয়, তাহলে মেধাবী শিক্ষার্থী তৈরি হবে।

শিক্ষার্থীদের যদি সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের কথা কিংবা নৈতিকতা চর্চার কথা বলা হয় তারা তা করতে চায় না কারণ তাতে ভয় হয় যদি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ না পায়। ফলশ্রুতিতে শুধু তৈরি হচ্ছে পরীক্ষার্থী! গুণাগুণসম্পন্ন শিক্ষার্থী তৈরি হচ্ছে না বলেই রাষ্ট্রে-সমাজের সর্বত্র দেখা যাচ্ছে বিশৃঙ্খলা দুর্নীতি আর ভণ্ডামি! অন্ধকারাচ্ছন্ন রাষ্ট্রকে আলোকিত করতে সব সমস্যার অবসান ঘটাতে ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার্থীর বদলে আদর্শ শিক্ষার্থী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে! এজন্য যত শিগগির সম্ভব পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

পাবলিক পরীক্ষাগুলো কমিয়ে এনে ছাত্রদের জ্ঞানার্জন করার পথ তৈরি করে দেওয়া এবং মৌলিক ও বিশ্লেষণধর্মী চিন্তার ক্ষমতা জাগানোর সুযোগ তৈরি হওয়া চাই! মোমবাতির মতো জীবনের সার্থকতা থাকার মন-মানসিকতা শিক্ষার্থীদের তৈরি হতে হবে।  অন্যকে আলোকিত করতে জীবনের অবসান ঘটানোর মানসিক অবস্থা তাদের তৈরি করতে হবে। সূর্যের যেমন দীপ্তি আছে তেমনি শিক্ষার্থীদের মাঝে একটি দীপ্তি থাকা চাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার। বর্তমান পৃথিবীটাকে যারা গ্লোবাল ভিলেজ হিসেবে আখ্যায়িত করে এর নিয়ন্ত্রণ করছে, আমাদের শিক্ষার্থীরা হয়তো বা একসময় তা গ্লোবাল সোসাইটি বানিয়ে নিয়ন্ত্রণ করবে!

আমাদের ভবিষ্যত্প্রজন্ম তখন মুখ তুলে গর্ব করে বলতে পারবে—এই গ্লোবাল সোসাইটি তো তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের দ্বারা! আর তখনই শিক্ষাব্যবস্থার সার্থকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটবে।

n লেখক :শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়