শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা :সম্ভাবনার নবযুগ

আপডেট : ২০ জানুয়ারি ২০২০, ২১:৩৯

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তথা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) জয়জয়কার এখন বিশ্বময়। উন্নত বিশ্ব এখন আরো বেশি ঝুঁকছে এই যুক্তির দিকে। ধারণা করা হচ্ছে, শুধু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঠিক প্রয়োগে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে ১৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়াবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসার বাংলাদেশে ঘটলে এদেশেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাত্রা অনেক গুণ বেড়ে যাবে।

আমাদের দেশকে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার শিল্পক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করতে পারে। ম্যাককিঞ্জি গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা মতে, আগামী ১২ বছরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব, যার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়তে বাধ্য। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে যেমন উত্পাদনের হার অনেক গুণ বেড়ে যাবে, সেই সঙ্গে উত্পাদনের সময়ও বর্তমানের তুলনায় কমে যাবে বহু গুণ। এরই সঙ্গে যেই কাজ বহু মানব শ্রমিক মিলে সম্পাদন করছে, তা হয়তো গুটিকয়েক যন্ত্র বা রোবটের মাধ্যমে অনেক সহজেই করা সম্ভব হবে। এ বিষয়ে একটা প্রশ্ন উঠতেই পারে, যন্ত্র যদি মানুষের জায়গা দখল করে নেয় তাহলে বেশ বড়ো একটা জনবল কর্মসংস্থান হারাবে। এ ক্ষেত্রে সমাধান হচ্ছে, যে পরিমাণ কর্মসংস্থান লোপ পাবে, তার থেকে বেশি বৃদ্ধিও পাবে। একটি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণায় দেখা যায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে বিশ্ব জুড়ে যেমন প্রায় ৭ মিলিয়ন কর্মক্ষেত্রের সুযোগ হারাতে পারে, তেমনি আরো ৭ দশমিক ২ মিলিয়ন কর্মক্ষেত্রের উদ্ভব হবে। এই কর্মসংস্থানের জোগান দিতেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক গবেষকের প্রয়োজন বেড়ে যাবে। আগামী ১০ বছরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন হয়ে দাঁড়াবে ১০ মিলিয়ন। তাই যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষার ব্যবস্থা সহজলভ্য হয় বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বাংলাদেশের উন্নতিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।

এরপর আসা যাক ঝুঁকিপূর্ণ কর্মকাণ্ডে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার। এখনো আমাদের দেশে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ খনিতে অন্য দেশের গবেষক নিয়োগ করা হয় প্রয়োজনীয় গবেষণার জন্য। যার কারণে বেশ মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হয়। যদি এ দেশের মানুষই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় শিক্ষিত হতে পারে তাহলে আর আমাদের অন্য দেশের গবেষকের প্রয়োজন হবে না। এখনো দেশের অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ আমরা দেশের প্রবৃদ্ধিতে ব্যবহার করতে পারছি না তার কারণ উপযুক্ত যন্ত্র এবং প্রযুক্তির অভাব। অথচ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় উত্কর্ষ লাভকারী দেশগুলো উপযুক্ত প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহার করতে পারছে। একটি ছোট্ট উদাহরণ দিলেই বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যাবে। বলা হয়ে থাকে, আমাদের দেশে প্রাকৃতিক গ্যাস সঞ্চিত আছে। যার যথাযথ ব্যবহার করা এখনো সম্ভব হয়নি উপযুক্ত প্রযুক্তির অভাবে। অনেক ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় যেমন কয়লার খনিতে মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে। এমন কিছু জায়গা আছে, যেসব জায়গায় মানুষের পক্ষে কাজ করা সম্ভব নয়, সেসব স্থানে রোবটের ব্যবহারের মাধ্যমে প্রায় সব রকম ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে কাজ করা সম্ভব হবে। শুধু তাই নয়, ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে সফল গবেষণাও যন্ত্রের মাধ্যমে করা সম্ভব। এতে দেশের সমৃদ্ধিও বাড়বে বহু গুণে।

এবার এমন কিছু এমন সমস্যার ব্যাপারে কথা বলা যাক, যা সমাধানে বুদ্ধিমত্তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা যানজট। বিশেষ করে ঢাকা শহরের যানজটের জুড়ি মেলা ভার। এর একটি প্রধান কারণ হচ্ছে সঠিক নিয়ম পালন না করা এবং অবশ্যই আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার না থাকা। উন্নত অনেক দেশেই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে রাস্তায় যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আমাদের দেশেও অনেক রাস্তায় এই প্রযুক্তির ব্যবহার দেখা যায়; তবে তা অতটা জোরালো নয়। এ ক্ষেত্রে, স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মাধ্যমে ট্রাফিক নিয়ম ভঙ্গকারীদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে অথবা পর্যবেক্ষণ এবং ওয়ার্নিং দিতে স্বয়ংক্রিয় রোবটের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যার ফলে মানুষ ট্রাফিক আইন মেনে চলতে বাধ্য হয়। কারণ মানুষের সঙ্গে আপস করা গেলেও যন্ত্রের সঙ্গে আপস করা সম্ভব নয়।

চিকিত্সা খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অনেকভাবেই সহায়তা করতে সক্ষম। দেশের সরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত ডাক্তারের সংখ্যা জনসংখ্যার অনুপাতে একজন চিকিত্সকের বিপরীতে চিকিত্সাপ্রার্থী মানুষের সংখ্যা ৬ হাজার ৫৭৯ জন। আর বিএমডিসি থেকে সনদপ্রাপ্ত (সরকারি-বেসরকারি) ডাক্তারের সম্মিলিত অনুপাতে এক জন চিকিত্সকের বিপরীতে সেবাপ্রার্থী ১ হাজার ৮৪৭ জন। দেশের চিকিত্সা ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো বিষয়, নির্ভুল রোগ নির্ণয়। অনেক আধুনিক যন্ত্র এবং দক্ষ ডাক্তার থাকার পরও অনেক সময় সঠিক রোগ নির্ণয় সম্ভব হয় না। সঠিক রোগ নির্ণয় না হলে রোগী ভুল চিকিত্সার সম্মুখীন হতে পারে। যার ফলে মানুষ সাবধানতা অবলম্বন করতেই দেশের বাইরে চিকিত্সার কথা ভেবে থাকে, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় এবং উপযুক্ত চিকিত্সার ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বহু মানুষকে অকাল মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। আধুনিক স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রাদি দিয়ে নির্ভুল সার্জারির মাধ্যমে সঠিকভাবে জটিল সব রোগ নির্মূল করা সম্ভব হবে। চিকিত্সার জন্য মানুষকে অকালে প্রাণ হারাতে হবে না আর দেশ-বিদেশে ঘুরতে হবে না। মানুষ তুলনামূলক কম খরচে বাংলাদেশেই চিকিত্সা করতে পারবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক চিকিত্সা সেবা আমাদের দেশের চিকিত্সা খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়ে আশীর্বাদ বয়ে আনবে বলে আমার বিশ্বাস।

শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার্থে বিভিন্ন জটিল গবেষণার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা যে কোনো বিষয়ের অতি গভীরে প্রবেশ করতে পারবে। যে বিষয়গুলো মানুষের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে ছিল, সেসব বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব হবে। তাই আমাদের ক্লাসরুমগুলো প্রযুক্তি শিক্ষার উপযোগী করে তুলতে হবে যেখানে শেখানো হবে ন্যানো টেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি, রেবোটিক্স, আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স, ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স, ইন্টারনেট অব থিংস, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, ব্লক চেইন টেকনোলজি ইত্যাদি। এসব বিষয়ে শিক্ষা প্রদানের জন্য শিক্ষকদের সঠিক ট্রেনিং প্রদান করা এবং প্রয়োজনে বিদেশ থেকে এক্সপার্ট শিক্ষক এনে আমাদের দেশের তরুণদের দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে নিয়োগের স্বচ্ছতা নিয়ে আমাদের দেশে প্রায়ই সমালোচনা করা হয়। এ সমস্যার পরিত্রাণ ঘটাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। পেশিশক্তির প্রভাব কিংবা স্বজনপ্রীতি দিয়ে মিলবে না কোনো চাকরি। বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে অনেক নামকরা প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মী নিয়োগ করে থাকেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পত্রিকা ফরচুনের তথ্য মতে, প্রায় ৫০০ নামকরা প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নিচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় প্রার্থীকে ভিডিওকলের মাধ্যমে সাক্ষাত্কার দিতে হয়। সেই ভিডিও কল থেকেই প্রার্থী সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। আপনার সব ধরনের অনুভূতি সম্পর্কে ধারণা দিতে সক্ষম এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। সে আপনার কথা শুনে বলে দিতে পারে আপনি কোন কাজে আসলেই দক্ষ, আপনি আসলেই নিজের সম্পর্কে সব সঠিক তথ্য দিচ্ছেন কি না, আপনি আত্মবিশ্বাসী কি না বা সাক্ষাত্কারের সময় আপনি ভীত ছিলেন কি না। এই প্রক্রিয়ার প্রার্থী সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা পেয়ে যায় প্রতিষ্ঠানগুলো এবং তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া অনেক বেশি স্বচ্ছ ও দ্রুত হয়।

বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ দেশ। আবহাওয়ার পূর্বাভাসের জন্য প্রচুর পরিমাণ ডাটা বিশ্লেষণ করতে হয়। অভিজ্ঞ আবহাওয়াবিদরাও সবসময় সূক্ষ্মভাবে তা বিশ্লেষণ করতে পারে না। বিজ্ঞানীরা এমন একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সফটওয়্যার তৈরি করতে পারে, যা সব ডাটা নির্ভুলভাবে বিশ্লেষণ, মানুষের মিস করা spot patterns আমলে নিয়ে অতি অল্প সময়ে নির্ভুল ফলাফল দেবে। সফটওয়্যারটি যখন একটি বড়ো ঝড় দেখবে তখন সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এবং গণমাধ্যমকে সতর্ক সংকেত পাঠাবে, যা জীবন বাঁচাতে সাহায্য করতে পারে।

আশার কথা হচ্ছে, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে জাতীয় কৌশলপত্র তৈরি করছে সরকার। প্রাথমিক খসড়া তৈরির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। আশা করা যাচ্ছে, কয়েক মাসের মধ্যে চূড়ান্ত খসড়া আনা হবে। ২০১৯ সালের মার্চের দিকে এই খসড়া তৈরি শুরু হয়। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৮ সালের নভেম্বরে ‘ডেভেলপমেন্ট অব ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ফর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ তৈরিতে পদ্ধতিগত কাজগুলো শুরু করে সরকারের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন বা এটুআই।

আমরা আশা করি, ডিজিটাল বিপ্লব তথা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সর্বোচ্চ সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০৪১ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সুখী, সমৃদ্ধ ও তথ্যপ্রযুক্তিতে আধুনিক ‘সোনার বাংলা’ হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে স্বমহিমায় স্থান করে নেবে।

n লেখক : সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন