শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ড্যান্ডির মরণফাঁদে শিশুরা

আপডেট : ২৫ জানুয়ারি ২০২০, ২১:৩৪

মীর আব্দুল আলীম

পথে দেখি শিশুরা নেশা করে। ছেলে শিশু, মেয়ে শিশু মিলেমিশে নেশায় আসক্ত হয়। খোদ রাজধানী ঢাকা ও আশপাশ এলাকায় প্রকাশ্যে প্রশাসনের চোখের সামনে নেশায় বুঁদ হতে দেখা যায় এসব পথশিশুকে। এমন  দৃশ্য দেখে সবাই। কিছু বলে না। যেন দায় নেই কারো, দায়বদ্ধতাও নেই। প্রশ্ন হলো—পুলিশ প্রশাসনের সামনে, আমাদের চোখের সামনে, ওরা নেশা করে কী করে? আমাদের কি বিবেক বলে কিছু নেই? কোনোই দায়দায়িত্ব নেই? সেদিন রাতে (২৩ জানুয়ারি) আমার শ্রদ্ধেয় মেজো মামা মাজহারুল হক ভুঁইয়ার টেলিফোন পেলাম। বোধ করি তিনি সেদিনই যাত্রাপথে এভাবে শিশুদের প্রকাশ্যে নেশা করতে দেখেন। আমাকে মোবাইল ফোনে বলছিলেন, ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের শিমরাইলে পথের ধারে প্রকাশ্যে ১০-১১ বছরের শিশুরা পলিথিনে ভরে কী যেন নেশা করছে। এটা নিয়ে একটা কলাম লিখো। সরকার ওদের পুনর্বাসন করুক। আমরাও না হয় সহযোগিতা করব’। দায়বদ্ধতা থেকেই হয়তো তিনি এমন কথা বলেছেন। আমি বললাম, ‘ড্যান্ডির নেশায় আসক্ত এসব শিশু। কথাগুলো বলতে আমারও লজ্জা হওয়া উচিত ছিল। আমিও তো এ দেশেরই একজন গর্বিত নাগরিক।’ মাস দুই আগে ছেলেকে রাজধানীর আরামবাগের নটের ডেম কলেজ থেকে আনতে গিয়ে কলেজের রাস্তায় কয়েকজন পথশিশুর জটলা দেখলাম। ওদের মুখ থেকে গানও শোনা যাচ্ছিল, ‘ভালোবাসি, ভালোবাসি, তুমি কম কম, আমি বেশি’। বুঝলাম, ওরা বেশ ফিলিংসে আছে। ওদের প্রত্যেকের হাতে পলিথিন। মুখে পলিথিন লাগিয়ে তারা ড্যান্ডি টানছে। ওদের একজন রায়হান। বয়স আট। জানাল, ‘বাবা-মা থ্যাইকাও নাই। ট্রেনে করে দুই বছর আগে নরসিংদী থেকে কমলাপুর আসি। মাল টানতে টানতে এখানে থাকা। বন্ধুদের সঙ্গে প্রথমে সিগারেট খাই। তারাই ড্যান্ডি ধরাইয়া দেয়। ড্যান্ডি খাওয়ার পর নিজেকে রাজা মনে হয়। ড্যান্ডি বানাইয়া খাইলে মনে দুঃখ থাকে না।’ প্রশ্ন করা মাত্রই মুচকি হেসে রিমন বলে, ‘মানুষের মাল টানা, রিকশা, ঠেলাগাড়ি ঠেলে, কেউ ভিক্ষা করে ড্যান্ডির টাকা জোগাড় করে।’ শুধু নটর ডেম কলেজ রাস্তা নয়, কমলাপুর স্টেশনের সামনের রাস্তা, ব্রিজের ওপর, আট নম্বর প্ল্যাটফরম, ছয় নম্বর বাস কাউন্টার সংলগ্ন ফুটপাত এবং খালি জায়গায় প্রতিদিন প্রায় ২০০ পথশিশু ড্যান্ডি খেয়ে বসে বসে ঝিমায়। মুখে পলিথিন দিয়ে শ্বাস নিতে মগ্ন থাকে।

কী আশ্চর্য কথা। শিশুদের হাতে এমন নেশা। রাজধানীর অতি নিকটে শিমরাইলে (চিটাগাং রোড) এমন নেশায় আসক্ত আরজ আলী। বয়স বেশি হলে ১১ হবে। বয়সের চেয়ে বেশি ইচড়েপাকা সে। বলে কি না, ‘দুই বেলা ড্যান্ডি খাইলে হয়। খাবার না খাইলেও চলে। ড্যান্ডি খাইলে ক্ষুধা লাগে না। ৬০ টাকা লাগে কিনতে। আপনারাই কন ৬০ টাকায় কি দুই বেলার খাবার জোটব?’ ড্যান্ডির মরণফাঁদে আটকে পড়া এ শিশুর প্রশ্নের জবাব কে দেবে? কেন এমন নেশার ফাঁদে জড়াল আমাদের শিশুরা? সালমা বয়স ১১ হবে। সে বলে কি না, ‘জীবনে সবই খেয়ে দেখেছি। প্রথমে বিড়ি খাইছি, এরপর গাঁজা। এখন পলিথিন টানি। এটার খরচ কম। কথার ফাঁকে পলিথিনের ভেতর জুতোর আঠা (গাম) মেশাচ্ছিল সে। পরে পলিথিনে ফুঁ দিল মেয়েটি। পলিথিনে মুখ দিয়ে বড়ো বড়ো শ্বাস নিল।

এভাবে কিছুক্ষণ শ্বাস টানার পর আরাম করে বসার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। জুতোর গাম পলিথিনে আটকে গেলে দুর্গন্ধ হয়। এরপর পলিথিন ফুঁ দিয়ে ফোলালে ভেতরে গ্যাসের সৃষ্টি হয়। মাদকাসক্তরা ওই গ্যাস নিশ্বাসের সঙ্গে টেনে নেয়। এতে নেশা হয়। বর্তমানে শিশুদের (আট থেকে ১৭ বছর) মধ্যে এ

পদ্ধতির নেশা খুবই জনপ্রিয়। এটা সংক্ষেপে ড্যান্ডি নামে পরিচিত। শিশু-কিশোর মাদকাসক্তদের নিয়ে কোনো জরিপ না থাকলেও বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার হিসাবে এ সংখ্যা অন্তত সাত-আট হাজার। অভিভাবকহীন সুবিধাবঞ্চিত এসব শিশু-কিশোর মাদক নিতে নিতে একসময় জড়িয়ে পড়ে নানা অপরাধে।

‘ড্যান্ডি’ এখন পরিণত হয়েছে মরণ নেশায়। রাজধানী ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জের শহরতলীসহ আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে এর ব্যাপকতা। লাগামহীন পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে চলছে এর বিস্তৃতি।

মাদক ব্যবসায়ীদেরও সহজ টার্গেটে পরিণত হচ্ছে স্কুল-কলেজের তরুণ-তরুণীরা। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট সূত্র মতে, ঢাকা বিভাগে মাদকাসক্ত শিশুর প্রায় ৩০ শতাংশ ছেলে এবং ১৭ শতাংশ মেয়ে। পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন জানায়, মাদকাসক্ত ৮০ শতাংশ পথশিশু মাত্র সাত বছরের মধ্যে অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। পথশিশুদের ভালো জীবন দেওয়ার অদম্য ইচ্ছে থেকে গড়ে ওঠা ‘অদম্য বাংলাদেশ’-এর আরিয়ান আরিফ বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করি এ শিশুদের মাদকাসক্ত হওয়া থেকে বিরত করতে। কিন্তু আমরাও সবসময় কাজ করতে পারি না। পুলিশি বাধার মুখোমুখি হতে হয়। যারা এ শিশুদের দিয়ে নানা অবৈধ কাজ করার চেষ্টা করে, তারা পুলিশের সহায়তা নিয়ে আমাদের নিরস্ত করার চেষ্টা করে। এরই মধ্যে আমরা যখন কিছু শিশুকে ভালো জীবন দিতে চাইলাম, বলা হলো আমরা শিশুদের পাচারের উদ্দেশ্যে এক জায়গায় রেখেছি, মিথ্যা মামলায় কারাগারে পাঠানো হলো। এ রকম সিস্টেমে কেউ কেন এগিয়ে আসবে এদের সহায়তা করতে? পুলিশ যদি একটু আন্তরিক হয় তাহলে এটা পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব বলেই মনে করেন সমাজ বিশেষজ্ঞরা।’

দেশ থেকে কেন মাদক নিয়ন্ত্রণ হয় না? মাদক পাচার, ব্যবসা ও ব্যবহারকারীর ক্রমপ্রসার রোধকল্পে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পর্যায়ে নানারকম কার্যক্রম দেখা গেলেও তেমন কোনো ইতিবাচক ফল মিলছে না। মাদক শুধু একজন ব্যক্তি কিংবা একটি পরিবারের জন্যই অভিশাপ বয়ে আনে না, দেশ-জাতির জন্যও ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনছে। নানারকম প্রাণঘাতী রোগব্যাধি বিস্তারের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও খারাপ করে তুলছে। সত্য যে, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার প্রকট রূপের পেছনে মাদক অন্যতম বড়ো একটি উপসর্গ হয়ে দেখা দিয়েছে। এর মতো উদ্বেগজনক ঘটনা আর কী হতে পারে? মাদক সেবনের কুফল সম্পর্কে মহাসমারোহে আলোচনা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়। বিভিন্ন এনজিও মাদক সেবন নিরুত্সাহিত করতে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। মাদকাসক্ত শিশুদের নিয়ে নানা সংগঠন নানাভাবে কাজ করছে কিন্তুই মাদকাসক্ত শিশুর সংখ্যা না কমে বরং বাড়ছে। সর্বনাশা মাদক থেকে যে কোনো মূল্যে তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে।

n লেখক :গবেষক