শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ট্রাম্পের ক্ষমতা রাজনৈতিক নয়, সাম্প্রদায়িক

আপডেট : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ২১:৫৮

আনুশে হোসেন

যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস হাউজ পরিশ্রান্ত। কিন্তু অন্যদিকে যদি এই বছরের শুরু থেকেই ধরেন, যেমন ইরানের জেনারেলকে হত্যা করা থেকে শুরু করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অভিশংসন পর্যন্ত, তাহলে কে বলবে যে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের কোনো ক্লান্তি আছে? আমেরিকার গণমাধ্যম শুরু থেকেই ট্রাম্পের অভিশংসনের বিষয়টি নিয়ে নিমগ্ন ছিল। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে জোরালো প্রমাণাদি থাকা সত্ত্বেও এবং নানা নাটকীয় ঘটনার পর এখন আরো একবার মনে হচ্ছে যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সব অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে যাচ্ছেন। আমার মনে হয় আমেরিকার জনগণ শেষ পর্যন্ত বুঝে গিয়েছে যে অভিশংসন একটি লিগ্যাল প্রসেস বা নিয়মতান্ত্রিক ব্যাপার। ট্রাম্পের অভিশংসন নিয়ে নানা ঘটনা এবং বাক-পরিবর্তনের পর এমনকি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টনের কাঁপিয়ে দেওয়া গ্রন্থ প্রকাশের খবরের পরও আমেরিকা বিশ্বের কাছে প্রমাণ করেছে যে দেশের প্রেসিডেন্ট সব ধরনের আইনের ঊর্ধ্বে। শুক্রবার দুজন রিপাবলিকান দলের সিনেটর শুনানিতে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যে অবস্থান নেওয়ার পরও সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠ রিপাবলিকানরা ট্রাম্পের পথ পরিষ্কার করে দিয়েছেন কেবল দলীয় স্বার্থের বিবেচনায়।

সিনেট জন বোল্টনের কথা শোনেনি। তার বইতে তিনি অভিযোগ করেছেন যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত মে মাসে ইউক্রেনের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তার কথা না শোনার ফলে ট্রাম্পের এই অভিশংসনকে কেন্দ্র করে সারা জীবনের মতো আমেরিকায় একটা পরিবর্তন হয়ে গেল।

আমেরিকান সরকার চিরকালই তিনটি সমান্তরাল শাখার দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। সেই তিনটি হলো নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। যারা সংবিধান রচনা করেছিলেন তাদের দ্বারা এই পদ্ধতি তৈরি ছিল চমত্কার। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতার অপব্যবহারকে রোধ করা। এবং যে কোনো ব্যক্তি যেন সরকারের ক্ষমতা একাই খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে। কিন্তু এই অভিশংসনের ঘটনা থেকে পরিষ্কার হয়ে গেল, সরকারের অন্যান্য বিভাগ থেকে প্রেসিডেন্ট অনেক ওপরে উঠে গেছেন। তাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে ভারসাম্যমূলক পদ্ধতি তৈরি করা হয়েছিল, তা থেকে যেন তিনি মুক্ত!

রিপাবলিকানরা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে শুনানি এড়িয়ে যেতে ভোট দিয়েছেন। তার অ্যাটর্নি অ্যালান দারশোভিচ প্রেসিডেন্টের নতুন এবং সমপ্রসারিত ক্ষমতার দাবি করেছেন। বলেছেন, পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত আগ্রহ জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সমার্থক। তাকে দায়মুক্তি দিয়ে সিনেট তাকে সে ক্ষমতা দিয়েছে।

ডেমোক্রেটিক কংগ্রেসম্যান এবং হাউজের ইমপিচমেন্ট ম্যানেজার অ্যাডাম শিফ এটাকে বলেছেন, ‘সাংবিধানিক পাগলামির উদ্ভব’। কিন্তু তার এই সতর্কবার্তা কোনো কাজে আসেনি। কারণ রিপালিকানরা, এমনকি যারা ট্রাম্পের আচরণে হতাশ, তারাও ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অবস্থান নেননি। এই অভিশংসনের মধ্য দিয়ে আরো একটি বড়ো পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। দেশটি একটি নতুন বার্তা দিয়েছে যে, ওকে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ক্ষতি করার জন্য তার অফিস এবং পররাষ্ট্রনীতিকে ব্যবহার করতে পারেন। অন্তত সিনেটের দ্বারা সেটাই প্রতীয়মান হয়েছে।

একজন বাংলাদেশি হিসাবে আমেরিকার রাজনৈতিক বিষয়গুলো আমার জন্য একটি অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা। দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। অথচ আমেরিকার মতো একটি দেশ যেখানে কেউই আইনের ঊর্ধ্বে ছিল না, সেখানে ট্রাম্পের অভিশংসন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ওই ইমেজটি নষ্ট করে দিয়েছে। যেখানে সারা বিশ্ব দেখতে পাচ্ছে যে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সাক্ষাত্ একটি দুর্নীতির সমস্যা, সেখানে অধিকাংশ আমেরিকানই তা অস্বীকার করছে। অস্বীকার, না প্রবঞ্চনা—কে জানে? কিন্তু এসব কোনো ব্যাপার না। কারণ ট্রাম্প অভিশংসিত হওয়া থেকে বেঁচে যাচ্ছেন।

যে ব্যক্তি একসময় বলেছিলেন যে নিউ ইয়র্কের ফিফথ অ্যাভিনিউতে তিনি যে কাউকে ফায়ার করলেও রাজনৈতিক সমর্থন হারাবেন না—তার কথাই ঠিক। ট্রাম্প এখন নিশ্চিতভাবেই জানেন যে তিনি ক্ষমতায় থেকে যা-ই করেন না কেন, রিপাবলিকান দল তার পেছনে আছে। এটা কোনো অতিরঞ্জিত কথা নয়। আমেরিকার সংবিধান ট্রাম্পের কাছে প্রমাণিত হয়ে গেছে এবং তিনি টিকে গেছেন।

এখন আমেরিকানরা নৈতিকভাবে দুর্নীতিবাজ প্রেসিডেন্টের অবসান ঘটাতে পারেন নভেম্বরে ব্যালটের মাধ্যমে। কিন্তু যত দীর্ঘ সময় সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করেছি ততই আমার মনে হয়েছে, আমেরিকার রাজনীতিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই টিকে যাওয়াটা রাজনৈতিক নয় বরং সাম্প্রদায়িক শক্তিপ্রসূত।

(ইংরেজি থেকে অনুদিত)

n লেখক : যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি সাংবাদিক, নারী অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ