শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

এতিম শহর কিংবা সত্-বাবার সংসারে বসবাস

আপডেট : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ২১:৩৫

জাজাফী

কী এক আশ্চর্য টানে প্রতিনিয়ত অগণিত মানুষ গ্রাম-গঞ্জ, মফস্সল শহর ছেড়ে পাড়ি জমাচ্ছে এক জাদুর শহরে, যার নাম ঢাকা। নাম ঢাকা হলেও আদতে তার পুরোটাই খোলা। ডাস্টবিন খোলা, ড্রেন খোলা, ম্যানহোল খোলা, ওভারব্রিজের ছাদ খোলা। অগণিত মানুষের ঘুমানোর জন্য কোনো ছাদ নেই। তারা প্রতি রাতে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটায়। দূর থেকে আশ্চর্য মায়াবি শহরটির সৌন্দর্য কল্পনা করে ছুটে আসা মানুষগুলো দুই দিনেই বুঝতে পারে যে সবটাই ভ্রম, ভেতরে ভেতরে শহরটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কংক্রিটের এই শহরে বিশুদ্ধ বলে যা কিছু আছে, ভেতরে ভেতরে কোনোটাই বিশুদ্ধ নয়। ঢাকা শহরের বতর্মান অবস্থা দেখে অনায়াসে বলা যায়, এটি একটি এতিম শহর। এর পিতামাতা বলে কিছু নেই। যদি থাকত, তবে অযত্ন-অবহেলায় আজ এর এমন করুণ অবস্থা হতো না। আর এ শহরে যারা বাস করছে, তারা যেন সত্-বাবার সংসারে বসবাস করছে। একান্তুই যারা ঢাকা শহরকে এতিম হিসেবে মেনে নিতে রাজি নন, তাদের জন্য বলা যেতে পারে, ঢাকা শহর এতিম না হলেও সত্-বাবার সন্তান হিসেবে দিন কাটাচ্ছে। নগরপিতা বলে আমরা যাদের সম্বোধন করছি, তারা সত্-বাবার ভূমিকায় অভিনয় করছেন। যে বাবা সত্-সন্তানের কীসে ভালো হয় কীসে মন্ধ হয় তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। সত্-ছেলে কোথায় গেল না গেল, কী খেল না খেল, তাতে তার কিছুই যায় আসে না। এতিম অথবা সত্-বাবার সন্তান বলেই  ঢাকা শহরের আজ করুণ অবস্থা।

চর্মচক্ষু দিয়ে যারা ঢাকা শহরের সুউচ্চ ভবন, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, বিলাসবহুল সিনেমা হল, নামিদামি রেস্টুরেন্ট, শপিংমল আর রাস্তায় দামি দামি গাড়ি দেখে এ শহর উন্নতির দিকে যাচ্ছে ভেবে আত্মতৃপ্তিতে ভুগছেন, তারা নিছক একটা অংশ দেখেছেন, যা তাদের সামনে। ধারণক্ষমতা বলে একটি কথা আছে, যা এই শহরের বিভিন্ন বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তরা কোনো দিন ভেবেও দেখেননি। তারা মনে করেন, শহরের আবার ধারণক্ষমতা কী? শহর তো শহরই! সামান্য একটি লিফটেও যেখানে বলে দেওয়া হয় ধারণক্ষমতা ৮ বা ১০ জন, সেখানে একটা পুরো শহর সেসবের বাইরে। তরতর করে গড়ে উঠছে সুউচ্চ ভবন। কোনোটি দশতলা, কোনোটি বিশতলা, আবার কোনোটি ত্রিশতলা। আমাদের নীতিনির্ধারকেরাই সেগুলোর অনুমোদন দিচ্ছেন। কিন্তু যেখানে দশতলা, বিশতলা বা ত্রিশতলা ভবন গড়ে উঠছে, সেখানকার ধারণক্ষমতা কতটুকু? ঐ যায়গায় যে পরিমাণ মানুষ বসবাস করতে শুরু করবে, তাদের জন্য পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি, বিশুদ্ধ বাতাস, খেলার মাঠ কি আছে? সেসব না ভেবেই সুউচ্চ ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এত মানুষের জন্য যে পরিমাণ অক্সিজেন দরকার, সে পরিমাণ সবুজায়ন কি  আমরা করতে পেরেছি? এত মানুষের জন্য বিদ্যুত্, গ্যাস, পানি সরবরাহ কোথা থেকে আসবে? পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থার কী হবে? রাস্তাঘাটে যানবাহনের যে চাপ তৈরি হবে, সেগুলো কী কেউ একবারও ভেবে দেখেছে?

আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ স্লোগান দিয়ে নিজেরাই নানাভাবে এনালগে আটকে আছি। নির্বাচনী প্রচারণায় কোটি কোটি পোস্টারে ছেয়ে ফেলি গোটা শহর। শহরটাকে যারা পরিষ্কার রাখবে বলে দায়িত্ব নিতে চায়, তারাই এটিকে সবচেয়ে বেশি নোংরা  করে রাখে। সাধারণ জনগণ পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন, বিলবোর্ড লাগায় না, ওগুলো সব অভিভাবকের তকমা গায়ে লাগানো সত্-বাবাদের কাজ। দিন যতই যাচ্ছে, এই শহরের অবস্থা আরো করুণ হচ্ছে। কোথাও কোনো কিছু পরিকল্পিতভাবে হচ্ছে না। আমরা হরহামেশাই রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি দেখতে পাই। আজ সুয়ারেজ লাইনের কাজের জন্য খোঁড়া হচ্ছে তো, কিছুদিন পর গ্যাসলাইনের জন্য ভালো রাস্তা আবার খোঁড়া হচ্ছে। সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে, জনদুর্ভোগ হচ্ছে। অথচ সঠিক পরিকল্পনা থাকলে রাস্তা একবার খুঁড়েই সব সমস্যা মিটিয়ে ফেলা যেত। সবকিছুর একটি ধারণক্ষমতা থাকে। এ শহরেরও ধারণক্ষমতা সীমিত, অথচ জনসংখ্যা এর ধারণক্ষমতাকে অতিক্রম করে গেছে বহু আগেই। তারপরও প্রতিনিয়তই লাখ লাখ মানুষ এই শহরে হাজির হচ্ছে অন্ধ মোহে। আমরা এই মোহ থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্য উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছি। ফলে দুর্গতি আরো বাড়ছে। বিদ্যুত্, গ্যাস, পানির সংকট প্রকট হচ্ছে। রাস্তায় যানবাহন বাড়ছে, যানজট ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। বাতাস দূষিত হচ্ছে, শহরের ওপর চাপ বাড়ছে, রোগাক্রান্ত হচ্ছে সব বয়সি। একটি বেলুন আপনি চাইলেই ইচ্ছেমতো ফোলাতে পারবেন না। তার একটি ধারণক্ষমতা আছে। তার বেশি ফোলাতে চাইলে তা ফেটে যাবে। এ শহরের ধারণক্ষমতা অনেক আগেই সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এর পরও যদি এভাবে চাপ বাড়তে থাকে। তবে বেলুনের মতোই এ শহরটা ফেটে যাবে। আমাদের এতিম শহরটাকে বাঁচাতে হবে। বাসযোগ্য ঢাকা নির্মাণের স্বপ্ন যদি নগরপিতাদের থেকে থাকে, তবে নগরবাসীদের প্রতি তাদের প্রথম আহ্বান হতে হবে ‘আসুন, আমরা আলোচনা করি ঢাকাকে কীভাবে বাসযোগ্য করে গড়ে তোলা যায়।’

n লেখক :শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়