বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

অস্ট্রেলিয়া প্রস্তুত হয়েছে, আমাদের স্বদেশ?

আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২০, ২২:০৩

আপনি বুঝতে পারেন আর না পারেন—অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না। বিশ্বযুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ এক বাস্তবতায় আজকের বিশ্ব। যুদ্ধ সাধারণত এক বা একাধিক দেশের ভেতর হয়। বাকিরা থাকে নিরাপদ দূরত্বে। এই যুদ্ধটা এমন সর্বগ্রাসী আর ভয়ংকর যে, দেবালয়-উপাসনালয়ও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বা দিতে বাধ্য হয়েছে সরকার কিংবা প্রশাসন। এমন বাস্তবতা দুনিয়া আগে দেখে নি। সামান্য এক ভাইরাস হলেও আজ এ এক মরণব্যাধি। ধর্ম সম্প্রদায় ধনী-গরিব নির্বিশেষে এর আতঙ্কে দুনিয়া অচল প্রায়। ইউরোপের সম্ভ্রান্ত আর ধনী দেশ নামে পরিচিত দেশগুলো আজ ঘোর বিপদে। ইতালি এক মৃত্যুপুরী। যেখানে সামরিক বাহিনীর ট্রাক বা কনভয় করে মধ্যরাতে মানুষের মরদেহ নিয়ে গিয়ে কোথায় যে সত্কার হচ্ছে কেউ জানে না।

একটি মন খারাপের করা ছবি দেখলাম সামাজিক মিডিয়ায় ভাইরাল। চীনের এক বয়স্ক রোগী তার মৃত্যু নিশ্চিত জেনে একবার শুধু জন্মভূমির সূর্যাস্ত দেখতে চেয়েছিলেন গোধূলির আলোয়। তাকে চলন্ত খাটে করে হাসপাতালের বাইরে এনে সেই ইচ্ছে পূরণ করেছে হাসপাতাল কর্মী। এমন বেদনা আর মন খারাপের ছবিতে আজ বিশ্ব কাঁদছে; কিন্তু এর ভেতরেও চলছে ব্যাপক অসংগতি আর নিয়ম না মানার উল্লাস। এমন না যে  মানুষ বুঝতে পারছে না; কিন্তু তাদের মনের ভেতর কী আছে কে জানে! তারা কি কেবল বাংলাদেশে নিয়ম ভাঙছে? মোটেই না।

খেয়াল করবেন—যেসব দেশ বা শহরে মরণের হার ব্যাপক বা বাইরে বেরুলে মরার ঝুঁকি বাড়ছে, সেখানেই মানুষ স্তব্দ হয়ে আছে। অথচ আমাদের এই অস্ট্রেলিয়ায়ও ঝুঁকি কিন্তু কম না। ইতিমধ্যে মানুষের জানও গিয়েছে। তারপরও গত শুক্রবার বিশ্বনন্দিত পর্যটন স্পট বন্ডাই বিচে যা দেখলাম তাতে এটা নিশ্চিত, লেখাপড়া জানা না জানা—সব একাকার। আর মানুষের পশু প্রবৃত্তি কিংবা আইন না মানার অভ্যাস কিংবা সামাজিকভাবে শৃঙ্খলা না মানার ব্যাপারটা সর্বজনীন। সরকার ঘোষিত সোশ্যাল ডিসটেনস বা দূরত্বসীমা ভেঙে বিচে হাজার হাজার মানুষ দেখে বুঝলাম—কক্সবাজার একা দোষী কিছু না।

এই ঘটনার পর অবশ্য সরকার বিচটি বন্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে। বাদবাকি দিকে অস্ট্রেলিয়া প্রস্তুতি নিয়েছে লকডাউনের। প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন মুখে যদিও বলেছেন ‘আই ওয়ান্ট ইউ টু গো অন’ আসলে ভালোই জানেন সবকিছু বন্ধের প্রস্তুতি চলছে। স্কুলকলেজসহ নানা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঝুঁকি দুইটি। একটি হচ্ছে বেতন-ভাতা দেওয়া আর একটি সামাজিক। এ দেশ আমাদের মতো না। এখানে পরিবার একক। মূলত অনেক একা মা বা বাবাই সামলায় সংসার। তাদের বাচ্চাদের কে বা কারা দেখভাল করবে? আর যাদের বাচ্চারা দাদ-দাদি, নানা-নানিদের কাছে থাকবে তাদের নিরাপত্তা কোথায়? কারণ করোনা ভাইরাস সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর বয়স্ক মানুষের জন্য। সব মিলিয়ে বেগতিক অবস্থা। তারপরও নিয়ম করে একটার পর একটা ঘোষণায় এটা নিশ্চিত—আমরা প্রস্তুত হচ্ছি।

এমন না যে বাংলাদেশের সরকার কিছু করছে না। ১০টি দেশের সঙ্গে শনিবার মধ্যরাত থেকে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত বিমান বাংলাদেশ চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত সঠিক। ভারত মালয়েশিয়াসহ ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কাকে স্যালুট জানাতেই হবে। ভারতে জন-কার্ফু, কুয়ালালামপুর লকডাউন, ম্যানিলা বন্ধ, কলম্বো আছে কার্ফুতে। এর মানে এই সরকারগুলো বুঝতে পেরেছে কতটা মারাত্মক হতে পারে আগামী দিন। বাংলাদেশ কেন এখনো এমন কিছু করতে পারছে না বুঝতে পারি না। এটা মানতেই হবে—যে দেশ যত জনবহুল তার সমস্যা ততবেশি। আমরা যারা চিকিত্সা বিজ্ঞান জানি না, বুঝি না তারাও জেনে গেছি এটি সংক্রমণ হয় মানুষে মানুষে। তা হলে কেন এই অবাধ মেলামেশার সুযোগ?

বলা বাহুল্য, সিডনি রোম লন্ডন নিউ ইয়র্ক বা মাদ্রিদ প্যারিস ঢাকা চট্টগ্রামের চেয়ে আধুনিক আর জনসংখ্যায় অনেক পিছিয়ে। সেখানেই যদি এটির সংক্রমণ রোধে জনবিচ্ছিন্নতা অপরিহার্য হয় আমাদের কী করা উচিত? আমি এটা নিশ্চিত—একবার যে ঘোষণা দেওয়া হবে সেটা মানতে বাধ্য নাগরিকেরা। কারণ পুলিশ আইন বা বিচার কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। এখন সামাজিক নিরাপত্তা সীমানা না মানলেই জরিমানা করা হবে। আর একটা বিষয় হচ্ছে মনিটরিং। মনিটরিং সেলগুলো জানে এবং বোঝে কী করছে। যেটা আমাদের সমাজে অসম্ভব। রাজনৈতিক নেতা এখানেও আছেন। মন্ত্রী আছেন; কিন্তু ঢালাও কথা বা যা খুশি বলার প্রতিযোগিতা নাই। এবং তা থাকবে না। কারণ তার মন্ত্রিত্ব যাবে সঙ্গে তার জীবন ক্যারিয়ারেরও বারোটা বাজবে।

আমাদের দেশে এসবের বালাই নাই। তাই ভয় হয়। কীভাবে সামাল দওয়া হবে এই বিরূপ পরিস্থিতি। আজ দুনিয়া বড়ো কাঁদছে। বারবার বলা হচ্ছে—এটি একা ঠেকানোর রোগ না, একে ঠেকাতে হলে সবাইকে একযোগে সহযোগিতা করতে হবে। আপনি একা একা ভালো থাকতে পারবেন না। শুধু আপনি না কেউ ভালো থাকতে পারবেন না।

n লেখক : সিডনি প্রবাসী কলামিস্ট