পৃথিবীর বুকে যত মহামারি আজ পর্যন্ত উদ্ভব হতে দেখা গেছে, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, প্রতিটিই বিশ্বব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন করেছে। সেই ধারাবাহিকতায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্ব মহামারি’ হিসেবে ঘোষিত করোনা ভাইরাসের প্রভাবও যে বেশ সুদূরপ্রসারী হবে তা বোধ করি বলাই বাহুল্য। ইতোমধ্যে করোনায় আক্রান্ত দেশগুলোর অর্থনীতিতে এর প্রভাব ভালোভাবেই পড়তে শুরু করেছে এবং দিন শেষে এ প্রভাব যে বিশ্ব অর্থনীতিকেও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, তা এখন থেকেই ভালোভাবে অনুমান করা যাচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতির পাশাপাশি বিশ্বরাজনীতির ক্ষেত্রেও পালাবদলের অশনিসংকেত বয়ে আনছে এ ভাইরাস। সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে ত্বরিত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সরকারব্যবস্থার সক্ষমতা প্রমাণ করলেও ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইরানের মতো দেশগুলো সঠিক সময়ে যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়ায় অনেকাংশেই জনগণের আস্থা হারিয়েছে। ফলে এসব দেশের রাজনীতিতে পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা যায়। চীন প্রথম দিকে করোনা নিয়ন্ত্রণে অদক্ষতার পরিচয় দিলেও সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে থাকলে শেষ পর্যন্ত নিজেদের ভুলগুলো শুধরে নিতে পেরেছেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। কিন্তু করোনা মোকাবিলায় অযোগ্যতা ও মন্থর সাড়া প্রদানের মাধ্যমে বিশ্বনেতৃত্বের ক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্ব নিজেদের সুনাম অক্ষুণ্ন রাখতে মোটামুটি ব্যর্থই হয়েছে বলা যায়।
সম্প্রতি আমেরিকার পলিটিকো ম্যাগাজিন সেদেশের ত্রিশের অধিক সচেতন নাগরিকের ওপর করোনা-পরবর্তী প্রভাব সম্পর্কে একটি জরিপ চালায়। জরিপে যে বিষয়গুলো উঠে আসে, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় ছিল করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সরকারের অসচেতনতা সরকারের প্রতি জনগণের একটি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি করছে, যা দেশটিতে রাজনৈতিকভাবে পরিবর্তন ঘটাতে পারে। অন্যদিকে ইরানে করোনা সংক্রমণের হার বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ইরানের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশেও এ ভাইরাস ছড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি লক্ষ করা যায়। ইরানের সরকার দীর্ঘদিন ধরে জনগণের আস্থা রাখতে ব্যর্থ বলে পরিগণিত হচ্ছিল, সেই সঙ্গে করোনা সংক্রমণে অদক্ষতার বিষয়টি সরকারকে আরো অপ্রিয় করে তুলছে। এছাড়া জাপানে শুরুতে ব্যাপকভাবে করোনা সংক্রমণ লক্ষ করা গেলেও পরবর্তী সময়ে জাপান সরকার দ্রুততার সঙ্গে চিকিত্সক ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি প্যানেল গঠন করে এবং আরো বেশ কিছু সময়োচিত পদক্ষেপের কারণে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। পাশাপাশি জাপানে অনুষ্ঠিতব্য অলিম্পিক গেমসের এবারের আসরও মুলতবি ঘোষণা করা হয়েছে সংক্রমণ ঠেকানোর পদক্ষেপের অংশ হিসেবে।
বর্তমানে ইতালির যে পরিস্থিতি; স্পেন, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের মতো দেশগুলো এর মাত্র এক ধাপ পেছনে রয়েছে বলে মতামত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। অন্যদিকে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে জাপান যেমন করোনা পরিস্থিতি সামাল দিয়ে উঠছে, পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরের পদক্ষেপ বিশ্ব জুড়ে বেশ প্রশংসিত হয়েছে। সিঙ্গাপুর সরকার উন্নতমানের চিকিত্সাব্যবস্থা নিশ্চিত করার পাশাপাশি জনগণকে সংক্রমণ রোধে যুগোপযোগী ও বিজ্ঞানভিত্তিক নির্দেশনা প্রদান করে, যা দেশটিতে আশঙ্কার তুলনায় সংক্রমণ কমিয়ে আনতে ভূমিকা পালন করে। চীনের সরকার অর্থনৈতিক ব্যয় ও নিরলস শ্রমের দ্বারা অবশেষে দেশটিকে সংক্রমণমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে এবং বর্তমানে আক্রান্ত দেশগুলোকে সহায়তা করার বিষয়েও চীনকে আন্তরিক বলেই লক্ষ করা যাচ্ছে, যা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের করোনার বিরুদ্ধে একধরনের জয় বলে বিবেচিত হচ্ছে। ফলে বিশ্বনেতৃত্বের পালাবদলের ক্ষেত্রে সমূহ সম্ভাবনা লক্ষ করছেন বিশেষজ্ঞরা। সিঙ্গাপুরের বিশ্লেষক কিশোর মাহবুবানির মতে, করোনা ভাইরাস-পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক বিশ্বায়নের পরিবর্তে চীনকেন্দ্রিক বিশ্বায়ন শুরু হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। এছাড়া মার্কিন অধ্যাপক স্টিফেন এম ওয়াল্ট ধারণা পোষণ করেছেন যে করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্বনেতৃত্ব পশ্চিমা বিশ্ব থেকে পূর্বের নিয়ন্ত্রণে চলে আসতে পারে। অর্থাত্, ইউরোপের চেয়ে ক্ষমতা ও প্রভাব এশিয়ায় বৃদ্ধি পাওয়ার ব্যাপারে ইঙ্গিত করেছেন তিনি। বিশ্বরাজনীতির পালাবদলের ক্ষেত্রে করোনা ভাইরাসের প্রভাব খুব সম্ভবত বেশ ভালোভাবেই পড়তে যাচ্ছে। এখন শুধু দেখার অপেক্ষা যে পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দিয়ে ঠিক কতদূর পরিবর্তন আনতে পারে এই করোনা ভাইরাস!
n লেখক :শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়