শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

হোম কোয়ারেন্টাইনে বই হোক সেরা সঙ্গী

আপডেট : ৩০ মার্চ ২০২০, ২১:১৯

প্রফেসর ড. মো. নাসির উদ্দীন মিটুল

করোনা ভাইরাস মহামারি যে বিশ্বব্যাপী ভয়ংকর আকার ধারণ করছে তা প্রতি ঘণ্টার পরিসংখ্যান লক্ষ করলেই সুস্পষ্ট। ৮ই মার্চ ২০২০ বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস ধরা পড়ার পর এর সংক্রমণ ঠেকাতে তত্পর গোটা দেশ। সংক্রমণ ঠেকানোর প্রথম উপায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়ানো। বাংলাদেশে এই রোগ এসেছে বিদেশ থেকে।

গত দুই সপ্তাহে বিদেশ থেকে প্রায় ২ লাখেরও বেশি মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে ফিরেছেন। বিদেশফেরত এসব ব্যক্তির অনেকের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়নি। তারা সারা দেশের বিভিন্ন জেলায় নিজ নিজ গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। আর এভাবেই গোটা দেশ করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

বিদেশফেরত ব্যক্তিরাই যেহেতু এদেশে জীবনঘাতী করোনা ভাইরাস নিয়ে আসার একমাত্র উত্স, তাই তাদের নিজ নিজ বাড়িতে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে। ফরিদপুরের শিবচর ও গাইবান্ধার সাদুল্ল্যাপুরে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার খবর গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। স্বভাবগতভাবেই বাঙালি-নির্ভীক, আলাপী এবং অতিথিপরায়ণ এক জাতি। প্রশ্ন হলো তাদের পক্ষে সুদূর ইতালি বা ইউরোপের কোনো দেশ বা মধ্যপ্রাচ্যে থেকে এসে ঘরে বসে থাকা কী করে সম্ভব? দশগ্রামের লোকজনকে আওয়াজ না দিলে, তাদের নিয়ে পাড়ার চায়ের স্টলে আড্ডা না দিলে, হাটবাজারে ঘুরে ঘুরে লোকজনের সঙ্গে করমর্দন, কদমবুসি, কোলাকুলি না করলে জানবে কী করে লোকজন যে তিনি বিদেশ থেকে এসেছেন? জানবে কী করে যে গ্রামের সবচেয়ে রংচঙা নতুন সুরম্য ভবনখানির তিনিই মালিক? এদের অনেকেই আবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হাতে ধরা পড়ে জেল-জরিমানা গুনছেন। অনেকেই অনেক অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার শিকার হচ্ছেন। অধিকাংশই এখন বাধ্য হয়ে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকছেন। হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তিদের জন্য বই হতে পারে সেরা এক সঙ্গী। মাত্র এই দুই সপ্তাহে আপনি পড়ে তুলতে পারেন এমন এক অভ্যাস, যা মহামারি-লগ্নে কিংবা মহামারি-উত্তর গোটা জাতিকে পথ দেখাতে সক্ষম।

অতীতে একসময় হয়তো আপনি ভালো একজন পাঠক ছিলেন। সময়ের পরিক্রমায় ব্যস্ততার নিরিখে সে অভ্যাসটি হয়তো ভোঁতা হয়ে গেছে। এই সুযোগে নিন-না সেটি ঝালাই করে। ঘরে বসে মোবাইলে হাজারটা গুজব; টিভিতে শত রকমের দুঃসংবাদ শুনে মন ভারাক্রান্ত করে কী লাভ? পড়ুন-না মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। পড়ুন-না একটি ভালো প্রেমের উপন্যাস, রবীন্দ্রনাথ পড়ুন। সমরেশ, শংকর পড়ুন। হুমায়ূন আহমেদ পড়ুন। অথবা শামসুর রাহমানের লেখা বিখ্যাত কোনো কবিতা পাঠ করুন। এর পরও কিছুই ভালো লাগছে না? পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ করুন। সুস্থ-সুন্দর জীবন যা সহায়তা করবে।

কোয়ারেন্টাইনের এই দুই সপ্তাহ আপনি উত্সর্গ করতে পারেন জ্ঞান-অন্বেষণে। এতদিন যে বইটি আপনি পাঠ করার প্রয়োজন অনুভব করেননি। ধুলোর আস্তর পড়ে আছে মলাটে। কোনোদিন ভাবেননি এত চমত্কার একটি বই অনাদরে অবহেলায় ফেলে রেখেছিলেন বুক-শেলফে। আজ যখন নিয়তি আপনাকে এ সুযোগ করে দিল তাহলে আর বিলম্ব কেন? গ্রামের বাড়িতে যদি পাঠোপযোগী বই না থাকে, তাহলে স্থানীয় প্রশাসনকে বলুন। তারা এর ব্যবস্থা করে দেবে। বাংলাদেশে এখন এমন একটি গ্রামও কি আছে, যেখানে লাইব্রেরি বা তথ্যকেন্দ্র নেই?

গত ২৪ মার্চ একটি পত্রিকার প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে দেখলাম, পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা খালিদা খাতুন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে বই উপহার দিচ্ছেন। তার উপজেলায় ৫৮ জন ব্যক্তি বিদেশ থেকে এসে হোম কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন, যাদের মধ্যে ৪৩ জনকে তিনি বই উপহার দিয়ে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। দারুণ এ মহতী উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন অনেকেই। প্রতিটি উপজেলায় যদি এভাবে স্থানীয় প্রশাসন কিংবা কোনো বিত্তবান ব্যক্তি অথবা কোনো স্থানীয় পাবলিক লাইব্রেরি বা এনজিও লাইব্রেরি এই উদ্যোগ গ্রহণ করে নিঃসন্দেহে তা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে সহায়ক হবে। পাশাপাশি কোয়ারেন্টাইনের এই বন্দি সময়টা সুন্দর ও সুস্থ চিন্তায় কাটবে। লোপ পাবে করোনা ভাইরাসের বিস্তার এবং বৃদ্ধি পাবে সচেতনতা।

তাছাড়া একজন তথ্য-পেশাজীবী হিসেবে আমরা জানি যে মাতৃত্বকালীন গর্ভাবস্থায় একজন মাকে একটি বই কীভাবে তার মানসিক বিকাশে সহায়তা করে। ‘বিবলিওথেরাপি’ বলে সুপরিচিত একটি কৌশল এই হোম কোয়ারেন্টাইনকালীন আমাদের সহায়তা করতে পারে। বিষয়টি একটু বিশ্লেষণ করা যাক। বিবলিওথেরাপি কী? বিবলিওথেরাপি হচ্ছে এমন একটি চিকিত্সাব্যবস্থা যেখানে রোগীর মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশে সাহিত্য/ বই/ লিটারেচারের সহায়তা নেওয়া হয়। এর মাধ্যমে রোগী তার  রোগসংক্রান্ত বিষয়ে সাকসেস স্টোরি পাঠ করে মানসিক সাহস সঞ্চার করেন। আরেকটু পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করলে বলা যায় যে একজন রোগী যদি তার রোগ সম্পর্কে সুস্থ হওয়ার বিভিন্ন খুঁটিনাটি তথ্য পায় এবং বেস্ট-প্র্যাকটিসগুলো আত্মস্থ করতে পারে, তাহলে তার মানসিক সাহস অনেক গুণ বেড়ে যায়, যা তাকে দ্রুত নিরাময়ে সহায়তা করে। পৃথিবীর অনেক দেশ বিবলিওথেরাপির মাধ্যমে অনেক ক্রনিক-ডিজিজের চিকিত্সা করে থাকে।

ক্রান্তিকালীন হোম কোয়ারেন্টাইনের এই সময়টাতে চায়নার উহানের সফল কাহিনি; ফ্রান্স ও জাপানের করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণকাহিনি হতে পারে আমাদের ১৭ কোটি বাঙালির মনোবল শক্ত রাখার এক অনন্য উদাহরণ। তাই বই, জার্নাল বা অন্য কোনো নন-বুক রিডিং ম্যাটেরিয়ালের সাহায্যে এসব সফল কাহিনি গল্পাকারে বোধগম্য ভাষায় পাঠ করলে হোম কোয়ারেন্টাইনের এই সময়টা দারুণ কাটবে। সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে উদ্বুদ্ধ হবে। আর এভাবেই সাময়িকভাবে নিজেকে অন্যদের কাছ থেকে দূরে রাখার মাধ্যমে সোশ্যাল ডিস্টেন্স তৈরি করে করোনা ভাইরাসের আগ্রাসি বিস্তার রোধ করা সম্ভব হবে।

করোনা ভাইরাস ঠেকানোর দায়িত্ব শুধু সরকার বা প্রশাসনের নয়। আপনার-আমার সকলের। মহামারি কোনো দলীয় বা রাজনৈতিক বিষয় নয়। ধর্মীয় বা ব্যক্তির ইগোর বিষয় নয়। ধনী-গরিবের বিষয় নয়। এ ধরনের দৈব-দুর্বিপাকে সব সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে এগিয়ে  আসা প্রয়োজন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা প্রয়োজন। বিপদে সমালোচনা বা বিমূঢ়তা নয়। দরকার দক্ষতা। বিপদ চিরদিন থাকে না। কিন্তু অর্জিত জ্ঞান অনন্তকাল আলো ছডায়। তাই আসুন পাঠাভ্যাস গড়ে তুলি। সুস্থ ও সুন্দর চিন্তার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করি কোয়ারেন্টাইনের এই কটা দিন।

n লেখক : ডিন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়