শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

একাদশ সংসদ নির্বাচন ও তারুণ্য

আপডেট : ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮, ২২:০৭

আমরা সবাই জানি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন ক্যারিশমেটিক নেতা এবং সফল রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন। জাতি হিসেবে আমরা সৌভাগ্যবান যে, আমরা বাঙালি; আমাদেরকে বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব দিয়েছেন। তবে আমরা জাতি হিসেবে যতটা সৌভাগ্যবান, তার থেকে অনেক বেশি দুর্ভাগা। কারণ জাতির পিতাকে যারা হত্যা করেছিল, তাদের আমরা প্রতিরোধ করতে পারিনি। বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম নির্বাচনী প্রচারণার অংশ হিসেবে বিএনপি’র পক্ষ থেকে যে ডকুমেন্টারি তৈরি করেছেন সেটার প্রেজেন্টেশনের গুণগত মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই, কিন্তু প্রশ্ন আছে শব্দচয়ন নিয়ে। তিনি মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে ‘পাকিস্তানি’ শব্দের বদলে ‘পাঞ্জাবি’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। তার মানে হলো পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি বিএনপি স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরেও মেনে নিতে পারেনি। তা না হলে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেও অন্তত ‘পাঞ্জাবি’ শব্দটা ব্যবহার করতেন না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘ঐক্যজোট’, বিএনপি ও ড. কামাল হোসেনের একাত্ম হওয়াটা জনমনে একটা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু ‘পাঞ্জাবি’ ও ‘খামোশ’— এই দুইটি শব্দের ব্যবহার যখন পর্যালোচনা করা হয়, তখন ঐক্যের কারণ ও প্রশ্নের জবাব কিছুটা পাওয়া যায়।

বঙ্গবন্ধু একজন মহান নেতা ছিলেন। তিনি তাঁর মহানুভবতা দিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন, কিন্তু ক্ষমা করেননি ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধীকে। বঙ্গবন্ধুই যাদের ক্ষমা করতে পারেননি, আমরা তাদের ক্ষমা করবো কোন্ অধিকারে? আর এত বড় ধৃষ্টতাই-বা আমরা কেন দেখাবো? স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তি যেকোনো সময় স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। দলমত নির্বিশেষে সবাইকে মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশের সংসদে শুধুমাত্র সরকারি দলই স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হলে হবে না, বিরোধী দলকেও স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি হতে হবে। তা না হলে জাতীয় সংসদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়। আমরা বারবার আমাদের জাতীয় সংসদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হতে দিতে পারি না। এবারও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২২ জন জামায়াতের নেতা বিএনপি’র ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করছে ছদ্মবেশে। ছদ্মবেশ এইজন্যই বললাম, জামায়াতের ওয়েবসাইটে জামায়াতের নেতা হিসেবে তাদের অস্তিত্ব এখনো বিরাজমান, জামায়াতের এই ২২ জন নেতা বিএনপি’র কাছে নমিনেশন বা সদস্যপদ কোনোটাই চায়নি। তার মানে হলো বিএনপি প্রকারান্তরে নির্বাচনের নামে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকেই প্রোমোট করছে, যা ভবিষ্যতে পুনরায় আমাদের জাতীয় সংসদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করতে পারে।

বঙ্গবন্ধু চলে গেলেন, কিন্তু রেখে গেলেন তাঁর সুযোগ্য কন্যা, বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। “Hasina: A Daughter’s Tale” ডকুড্রামাটি দেখলে বোঝা যায়, কিভাবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বাস্তব জীবনের প্রতিকূলতাগুলোকে মোকাবিলা করে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন, নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন, বাংলাদেশের জনগণের জন্য গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। মূলত, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে বিগত দশ বছরে। তিনি বাঙালি জাতিকে, বাংলাদেশকে যতটা সময় দিয়েছেন, নিজের সন্তানদের ততটা সময় দেননি, কিন্তু তিনি রত্নগর্ভধারিণী। তাঁর দুইটি সন্তান: একজন আইসিটি নিয়ে কাজ করছেন, অন্যজন অটিজম নিয়ে কাজ করছেন। বিজ্ঞান আর মানবিকতার এক অপূর্ব সমন্বয়।

ঐক্যজোটের অন্যতম দাবি ছিল, নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন। ২৪ ডিসেম্বর থেকে সারাদেশে সেনাবাহিনী স্ট্রাইক ফোর্স হিসেবে নিয়োজিত আছে। কিন্তু ঐক্যজোট বা বিএনপি’র উত্সবমুখর নির্বাচনী প্রচারণা দেখা যাচ্ছে না। কারণ রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়েছে, বিএনপি’র মধ্যে যথেষ্ট সমন্বয়ের অভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। এছাড়াও ২০১৪ ও ২০১৫’র ধ্বংসাত্মক আন্দোলন বিএনপি’র কর্মীদের হতাশাগ্রস্ত করে ফেলেছে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের সারা বাংলাদেশে উত্সবমুখর প্রচারণা দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে ছিল। কিন্তু ২১ বছরে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে আরও শক্তিশালী ও গঠনমূলক হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে, তখনও আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সব থেকে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল ছিল, এখনো আছে। এমনকি ১৯৯০’র গণঅভ্যুত্থানের সময় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে, পরে ১৯৯১ সালে সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দলের ভূমিকায় ছিল আর বিগত দশ বছরে আওয়ামী লীগ শুধুমাত্র রাজনৈতিক দল নয়, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে। এতোটা শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েছে সেটা পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, এটা দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও গবেষণার বাস্তব ফল। ঐক্যজোটের ইশতেহারের প্রসঙ্গে আলোচনা নাই-বা করলাম, কারণ ঐক্যজোটের ইশতেহারের যদি গুরুত্ব থাকতো, তবে বিএনপি নতুন করে কোনো ইশতেহার দিতো না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র ইশতেহারের শুধুমাত্র কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ কতটা দক্ষ ও দূরদর্শিতা সম্পন্ন।

আওয়ামী লীগের ইশতেহারে বিশেষ অঙ্গীকার হিসেবে তারা দুইটি অঙ্গীকার করেছেন: ‘আমার গ্রাম আমার শহর: প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারণ’ এবং ‘তারুণ্যের শক্তি, বাংলাদেশের সমৃদ্ধি: তরুণ  যুবসমাজকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর ও কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা’। আওয়ামী লীগের ইশতেহারে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর বিষয়ে মেধা ও দক্ষতা বিবেচনায় রেখে বাস্তবতার নিরিখে যুক্তিসঙ্গত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এমন উল্লেখিত রয়েছে। বিএনপির ইশতেহারে দেশ রক্ষা, পুলিশ ও আনসার ব্যতীত শর্তসাপেক্ষে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে কোনো সময়সীমা থাকবে না বলে উল্লেখ আছে। বাংলাদেশে বর্তমান যুবক ৫ কোটি ৩০ লাখ। যদি বিএনপি’র ইশতেহারে চাকরিতে প্রবেশের কোনো বয়সসীমা না থাকে, তবে তারুণ্যের জন্য কর্মসংস্থানের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ সেক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা প্রাধান্য পাবে। শুধুমাত্র যদি আওয়ামী লীগের বাস্তব পরিকল্পনা ও বিএনপি’র ভবিষ্যত্ পরিকল্পনার তুলনামূলক আলোচনা করা হয়, তাহলেও আওয়ামী লীগ বিএনপি’র তুলনায় আড়াই গুণের গুণেরও বেশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে। অর্থাত্ আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের ৫ কোটি ৩০ লাখ যুবকের মধ্যে ২ কোটি ৬০ লাখ ৯০ হাজার যুবকের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করবে। শুধুমাত্র তারুণ্যের ১০০ ভাগ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার জন্য আগামী নির্বাচনে মহাজোটের বিজয় লাভ করা বাংলাদেশের জন্য দরকার, কারণ আওয়ামী লীগ শুধুমাত্র তারুণ্যের বাংলাদেশকেই নিশ্চিত করছে না, সাথে সাথে ‘আমার গ্রাম আমার শহর: প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধার সম্প্রসারণ’ সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের উন্নয়নকেই নিশ্চিত করে।

n লেখক: অধ্যাপক ও ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া