শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

আমাদের ভুবন থেকে বিদায় হে বিস্ময়শিল্পী

আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮, ২২:১৯

দুই বছর আগে ৩০ জুন সামাজিক মাধ্যমগুলোতে মৃণাল সেনের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়েছিল। সেটা ছিল গুজব। কিন্তু বছরের অন্তিমক্ষণে মৃণাল সেন সত্যিই সত্যি অন্তিমযাত্রায় চলে গেলেন। ৯৫ বছর বয়সে চিরবিদায় নেওয়ার মাধ্যমে মৃণাল সেন যেন অস্ফুটেই বলে গেলেন—প্রতিটা মানুষই শুধু নিজের। তিনি সেসব পরিচালকের একজন যিনি সর্বদাই ভাঙার চেষ্টা করেছেন যাবতীয় কৃত্রিম কাঠামোকে। সেই কবে থেকে বিশ্ব চলচ্চিত্রের মহান এক অধিপতি হয়ে হেঁটেছেন কত দুর্গম পথ। হাঁটতে শুরু করেছেন এই বাংলার এক সবুজ শহর থেকে। সে প্রায় এক শতাব্দীর গল্প। হেমিংওয়ের সান্তিয়াগোর মতো জীবন-সমুদ্রের উপকূলে প্রতিটি দিনকেই তিনি গ্রহণ করেছিলেন পৌরুষের চ্যালেঞ্জ হিসেবে। প্রকৃতিও দিয়েছিল সুঠাম গড়ন। তাই মৃণাল সেনের প্রতিটি নিবিষ্ট স্টিল ফটোগ্রাফকে আমাদের ভ্রম হতে পারে অ্যাঞ্জেলো বা রোদ্যাঁর ছেনির কাজ বলে।

মৃণাল সেন জন্ম নিয়েছেন ১৯২৩ সালে ১৪ মে, ফরিদপুর শহরে। ত্রিশ-চল্লিশের দশকের ফরিদপুর ছিল নীরব, নিথর, সলাজ এক শহর। চুন-সুরকির সম্ভ্রম জাগানো এক সাদা বাড়ি। বৃক্ষচ্ছায়ায় মায়াময়, সারাদিন নারকেল-সুপারির আল্পনা আঁকা উঠোন। রোদের রেণুভরা দুপুর। জীবনানন্দের বুকের পশমের মতো নরম ঘাসে ভরা পেছনের পালানটুকু পেরোলেই ধু ধু ঢোলসমুদ্র। ঢোলসমুদ্রের কিনারে দুর্গের মতো দাঁড়িয়ে প্রত্নচেহারার চাঁদমারী। দূর পৃথিবীর ঘ্রাণ এনে বাড়ির পুকুরের ঘাটলায় মাখত ঢোলসমুদ্রের ঢেউ। এসব দৃশ্য নিশ্চয়ই গেঁথে গিয়েছিল মৃণালের যৌবনস্মৃতিতে। গ্রীষ্মের প্রথম বৃষ্টিচষা মাঠের জমি থেকে পল্লীকবির হূদয়ের সুরভি মেখে যে সোঁদা গন্ধ  ভেসে আসত, তার জন্য যেন মৃণালের পরানের গহিনেও জেগে উঠত কোনো অপার বেদনা। দিল্লি, ভেনিস, কান, বার্লিন মস্ত মস্ত সব উত্সবে হয়েছে মৃণাল সেনের প্রতিভার অভিষেক। তার বুক ঝলমলিয়ে উঠেছে স্বর্ণময় ক্রেস্টের শোভায়।

অথচ বুকের নিচেই যে হূদয়, তা খালি হয়েছিল সুদূর শৈশবে। কেউ সেই শূন্যতা ভরে দিতে পারেনি। কবিতার কাজলাদিদির মতো একটা বোন ছিল মৃণাল সেনের, নাম রেবা। একদিন পুকুরের জলে ডুবে মারা যায় সেই বোন। বোন হারানোর শোক দিয়ে তাঁর পরিবার ফরিদপুরের বাড়িতে গড়েছিল ধূসর এক স্মৃতিস্তম্ভ। স্তম্ভটি ছুঁয়ে হারানো বোনটিকে অনুভবে পাওয়ার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ১৯৯১-তে, যেবার মৃণাল সেন অনেককাল পর বাংলাদেশে এসেছিলেন, ফরিদপুরে এসেছিলেন।

ছাত্রাবস্থায় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক শাখার সঙ্গে যুক্ত হন। যদিও তিনি কখনও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হননি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার পর তিনি কখনও একজন সাংবাদিক, কখনওবা ওষুধ বিপণনকারী, আবার কখনও চলচ্চিত্রে শব্দকুশলী হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৫৫ সালে ‘রাত ভোর’ পরিচালনা করার আগেও ১৯৫০ সালে ‘দুধারা’ নামে একটি সিনেমা পরিচালনার সঙ্গে অনাম্নী হিসেবে যুক্ত হন তিনি। ‘রাত ভোর’-এর পর তার ছবি ‘নীল আকাশের নীচে’। ‘বাইশে শ্রাবণ’-এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক খ্যাতি মেলে। তবে ১৯৬৯-এ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ভুবন সোম’-এর মাধ্যমে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতি আসে। ২০০২ সালে মুক্তি পায় তাঁর সর্বশেষ ছবি ‘আমার ভুবন’। সর্বমোট ২৮টি পূর্ণদৈর্ঘ্য ও ৪টি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় ৬টি চলচ্চিত্রবিষয়ক মৌলিক গ্রন্থও লিখেছেন মৃণাল সেন। তার সিনেমায় তিনি নিজের বক্তব্যের কাঠামোকে শান দিয়েছেন মার্ক্সবাদ, অস্তিত্ববাদের সারাত্সার দিয়ে। বিষয়ের ভিন্নতার কারণে ছবির আঙ্গিকে তুমুল পরিবর্তন এনেছেন তিনি। টুকরো টুকরো বাস্তব দৃশ্য ও শব্দ দিয়েই তিনি নিজের বক্তব্য পেশ করেছেন। সব ফিল্মমেকারের কাছেই ফ্রিজ-শটের অর্থবহ প্রয়োগের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হয়ে আছে ফ্রাঁসোয়া ক্রফোর Four Hundred Blosw-এর শেষ দৃশ্যটি। মৃণাল সেনের স্মৃতিতে তারচেয়েও অর্থবহ একটা ফ্রিজ শট ছিল। ঘটনাটি ১৯৬৯ সালের। মৃণাল সেনের মা তখন প্রায় শয্যাশায়ী। ডাক্তারের কড়া নিষেধ চলাফেরার ওপর। সে সময় পল্লীকবি জসীমউদ্দীন যান রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি.লিট উপাধি নিতে। জসীমউদ্দীন মৃণাল সেনের বড়দা’র বন্ধু। ফরিদপুরে থাকতে সেনদের বাড়িতে খুব যাতায়াত ছিল। মৃণাল সেনের মা জসীমউদ্দীনকে নিজের ছেলের মতো আদর করতেন। মুখে তুলে ভাত খাওয়াতেন। মৃণাল সেন সেদিন জসীমউদ্দীনকে গাড়িতে করে বাসায় নিয়ে যান। জসীমউদ্দীন ‘মা’, ‘মা’ বলে ডাকতে ডাকতে দোতলায় উঠতে থাকেন। মৃণালের ‘মা’ ডাক্তারের নিষেধের তোয়াক্কা না করেই খাট থেকে প্রায় লাফিয়ে নেমে জসীমউদ্দীনকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন মা ও ছেলে—‘সাধু তুই এসেছিস, বাপ আমার, কত দিন দেখি না।’

কী মহত্তম এই দৃশ্য—হিন্দু জড়িয়ে আছে মুসলমানকে, পশ্চিমবাংলা পূর্বকে, নাকি মানবতা রাজনীতিকে? মৃণাল সেন কী দেখেছিলেন সেদিনের এই ফ্রিজ শটে? দেশভাগ নিয়ে কত কেতাব লেখা হয়েছে। একখানা সহি কেতাবের নাম আমাদের মনে খুব লেগে আছে, ‘অপারেশন উইদাউট অ্যানেস্থেশিয়া’। এই অপারেশনের এক বড় বলি ঋত্বিক ঘটক। মৃণাল সেনও কি নন? পুরস্কার-সম্মান যেন তার জীবনে এসেছে স্বাভাবিক নিয়মেই। ১৯৮১ সালে পান পদ্মভূষণ সম্মান। ২০০৫ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত সংসদের সাম্মানিক সদস্যও ছিলেন। ফরাসি সরকার তাকে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান কম্যান্ডার অফ দি অর্ডার অফ আর্টস অ্যান্ড লেটারস সম্মানে সম্মানিত করেন। ২০০০ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাকে ‘অর্ডার অফ ফ্রেন্ডশিপ’ সম্মানে ভূষিত করেন।

এত সম্মান, এত পুরস্কার, তা সত্ত্বেও ছবির খিদে মেটেনি এই সৃজনশিল্পীর। শোনা যায়, শেষ দিকে তিনি বলতেন, প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ভাবি ছবি করার কথা। আর ভাববেন না ছবি করার কথা, আর আমাদের ভাবাবেন না নতুন বিস্ময়ে।

আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা গ্রহণ করুন চলচ্চিত্রের হে বিস্ময়শিল্পী!

n লেখক :যুগ্ম আহ্বায়ক, মৃণাল সেন চলচ্চিত্র সংসদ